তৃতীয় দিনে দেখল।
দেখল এক হাতে বুকের সঙ্গে ঠেকানো একগাদা বই, অন্য হাতে বড়সড় পোর্টফোলিও ব্যাগ একটা–দুই হাতই জোড়া, বাসের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
গাড়িটা আচমকা পাশে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যেতে প্রায় আঁতকে উঠেছিল। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপের আগেই অর্চনা দরজা খুলে দিয়ে ডাকল, আসুন–
মায়ের পাল্লায় পড়ে বছরে একটা করে পাড়ার অভিজাত ক্লাবের সাংস্কৃতিক অভিনয়ে যোগ দিতে হয়। আসরে একবার নেমে পড়লে অর্চনা আলগা সংকোচের বড় ধার ধারে না। কিন্তু যাকে ডাকল তার অবস্থা নয়নাভিরাম।
আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ, আসুন–
যে-মেজাজের মানুষই হোক, সেই মুহূর্তে সুখেন্দু মিত্রের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা। কি করবে ভেবে না পেয়ে বিব্রত মুখে আহ্বানকারিণীর দিকেই তাকাল সে।
পিছনে একটি বাস আটকে পড়ে হর্ন বাজিয়ে বিরক্তি ঘোষণা করল। অর্চনা বলল, তাড়াতাড়ি উঠুন, এটা বাস-স্টপ!
বেগতিক দেখে সুখেন্দু মিত্র উঠেই পড়ল। গাড়ি চলল।
অর্চনা ধারে সরে গেছে। সেদিকে চেয়ে সুখেন্দু মিত্র আরো একটু বিব্রত, এভাবে টেনে তোলার পর পার্শ্ববর্তিনীর সাধারণ আলাপের ইচ্ছেটুকুও নেই যেন। এ-রকম একটা বিড়ম্বনার মধ্যে সে কখনো পড়েনি।
একটু বাদে অর্চনা নিস্পৃহ দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল। কিছু যেন স্মরণ করতে চেষ্টা করে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?
নিরুপায় সুখেন্দু মিত্র হাসতে লাগল।
অর্চনা হাসিমুখেই ঘুরে বসল একটু। এই কাণ্ড করে বসারস্পরে সহজতাই স্বাভাবিক। বলল, গাড়িতে উঠতে চাইছিলেন না কেন, বাসের ভিড় ঠেলতেই ভাল লাগে বুঝি?…তাই বা পারতেন কি করে, দু-হাতই তো জোড়া।
সেদিনের বাসের ব্যাপারটা মনে পড়তে সুখেন্দু মিত্র জোরেই হেসে উঠল। তার পর আলাপটা অন্যদিকে যোরাবার জন্য তার হাতের বইগুলোর দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি পড়েন?
ভদ্রলোক কলেজের প্রফেসার তাই বোধহয় আলাপের এই বিষয়বস্তু তেমন পছন্দ হল না অর্চনার। বইগুলোর কোলের ওপর থেকে পাশে আড়াল করে জবাব দিল, না … আমার বোন পড়ে।
বোনটিকেও সেদিনের পার্টিতে এর পাশে দেখেছিল মনে পড়ছে! কি ভেবে আবারও জিজ্ঞাসা করল, আপনার বোন কি পড়েন?
আই এ।
সুখেন্দু কৌতুক অনুভব করছে বেশ। টয়েনবী আজকাল তাহলে আই এ তে পড়ানো হয়, আমাদের সময় ওটা এম, এ-তে পড়ানো হত।
ধরা পড়ে অর্চনা আবারও হেসে ফেলল।
একটু বাদে সুখেন্দু মিত্র নিজে থেকেই বলল, সেদিন মিন্টুদের বাড়িতে শুনলাম ডক্টর জি, এন, বাসু আপনার বাবা–
সঙ্গে সঙ্গে অর্চনার মনে দুই একটা নীরব প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি…। শুনেছে যখন খুব সম্ভব ইলা-মাসির কাছেই শুনেছে। কিন্তু ও কার মেয়ে সেটা শোনার কারণ ঘটল কি করে? শোনার আগ্রহ না থাকলে ইলা-মসি শোনাতেই বা যাবে কেন? মনে মনে তুই একটু।-হ্যাঁ, বাবাকে চেনেন নাকি আপনি?
ছেলে পড়াই আর তার নাম জানব না। তবে তার ছাত্র না হলেও তাকে চেনার আমার একটা বিশেষ কারণ ঘটেছিল। অনেক কালের কথা, এখন বোধহয় তাঁর মনেও নেই।
অর্চনা ঈষৎ আগ্রহ নিয়েই জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছিল বলুন তো?
না, তেমন কিছু নয়। প্রসঙ্গটা চাপাই দিল সে, আপনি তো য়ুনিভার্সিটিতে যাবেন, আমি একটু এদিকেই নামব। সেজন্য প্রকাশ করল, আজ ভালই আসা গেল…। আপনার বাবাকে প্রণাম দেবেন, চিনলে চিনতেও পারেন, খুবই চিনতেন—
এর পরেও একটা আমন্ত্রণ না জানানো বিসদৃশ।-একদিন আসুন না আমাদের বাড়ি, বাবার সঙ্গে দেখা হবে~-আসবেন?
আসবে বলেই মনে হল, কারণ বাড়ির ঠিকানা নিয়ে রাখল সে।
কিন্তু আসেনি। আসেনি বলেই অর্চনাও আর বাস-স্টপের মোড়ে গাড়ি থামায়নি। পাছে দেখা হয় তাই রাস্তার উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে বাস-স্টপটা পেরিয়ে গেছে। অবশ্য সেই দিনই সে কলেজ থেকে ফিরে বাবাকে সুখেন্দু মিত্রের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। আর তার ফলে মায়ের হাতে ধরা পড়ে নাজেহাল।
বাবা কিছু একটা লিখছিলেন। অন্যমনস্কও ছিলেন। অর্চনা তার লেখার টেবিলেই পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছে, আচ্ছা বাবা, তুমি সুখেন্দু মিত্র বলে কাউকে চিনতে?
বাবা মনে করতে পারেননি তাকে খুব চেনে শুনেই অর্চনা ভদ্রলোককে বাড়িতে আমন্ত্রণ করেছে। এখন বাবা তাকে আদৌ না চিনলে মেয়ের নিজেরও একটু সংকোচের ব্যাপার। অচন। তাই চেনাতে চেষ্টা করেছে, বলেছে, একজন প্রফেসার, তোমাকে খুব চেনেন বললেন–তোমার ছাত্র না হলেও অনেকদিন আগে কি ব্যাপারে তোমার সঙ্গে খুব আলাপ হয়েছিল বললেন
এর পরেও ডক্টর বাসুর মনে পড়েনি।
কিন্তু এ নিয়ে যে আবার আর এক ঝামেলায় পড়তে হবে অর্চনা জানবে কি করে। মা ওদিকে ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন এতক্ষণ। এক বান্ধবীর বাড়ি যাবেন, মেয়েকেও নিয়ে যাবেন কথা দিয়েছেন। নিজে সাজসজ্জা করে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। মেয়েকে বাপের ঘরে ঢুকতে দেখে প্রস্তুত হবার জন্যে তাড়া দিতে এসে তার জিজ্ঞাসাবাদ শুনলেন। বলা বাহুল্য, শুনে খুব প্রীত হলেন না।
তার সঙ্গে তোর আলাপটা হল কখন?
অর্চনা প্রায় চমকই ফিরে তাকিয়েছিল, তার পর বিব্রতমুখে জবাব দিয়েছে, না, আলাপ না…য়ুনিভার্সিটি যাবার মুখে দেখা হয়ে গেল!
তুই তো গাড়িতে গেছলি?
অর্চনার কাহিল অবস্থা, তবু চেষ্টা করেছে সামলাতে।-হ্যাঁ, রাস্তায় খুব ভিড় ছিল ভদ্রলোক একেবারে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, এদিক থেকেই বাসে ওঠেন কিনা–