টাকার অঙ্কটা শুনে ননিমাধব টেক গিলে বলল, বলেই ফেলি, অ্যাঁ?
নিশ্চয়। এরপর আর যত দেরি হবে তত ক্ষতি–
ক্ষতিপূরণের মত করেই খাবারের ডিশটা হাতের কাছে টেনে নিল সে। কিন্তু এবারে তার সেই চেষ্টায়ও ব্যাঘাত ঘটল। ননিমাধব আমতা আমতা করে বলল, আচ্ছা বিজুদা টার্গেটটা একেবারেই দশটা না করে আমরা যদি এখন ছ’টা করি।
ছটা! পার্টনারের প্রস্তাব শুনে বিজন আহত-দশটাই তো কিছু নয়। নতুন প্ল্যানে হাজার হাজার মাইল রাস্তা হচ্ছে এখন–সর্বত্র তো সাইকেল-রিকশই চলবে! যে-রেটে ডিম্যাণ্ড বাড়ছে, দাঁড়াও, দেখাই–
স্ত্রীর উদ্দেশে বলল–রাণু, আমার সেই চার্ট আর–
থেমে গেল। স্ত্রী এ রাজ্যে নেই। বিরক্তমুখে নিজেই চেয়ার ঠেলে উঠে চার্ট আর প্ল্যান আনতে বেরিয়ে গেল সে।
বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে এবারে নানাবিধ খাবারের ডিশটা সামনে টেনে আনল। চা তো জুড়িয়ে জল। কিন্তু খাওয়া আজ কপালে লেখা নেই বোধহয়। বাইরের বারান্দা ধরে টকটক জুতোর শব্দ শোনা গেল। বলা বাহুল্য সে শব্দ কোন পুরুষ-চরণের নয়। ননিমাধবের মুখের রঙ বদলায় সঙ্গে সঙ্গে। খাবার ছেড়ে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বার করল সে। কিন্তু সেটা মুখ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই দোরগোড়ায় যে এসে দাঁড়িয়েছে, সে বরুণ।
বরুণা জানান দিল, দিদি নয়, আমি।
হাসতে চেষ্টা করে ননিমাধব বলল, হ্যাঁ— রুমালটা পকেটে।
বরুণা ঘরে ঢুকে সরাসরি দাদার চেয়ারেই বসে পড়ল। ঝুঁকে বউদির হাতের বইখানার নাম পড়ে ছোটখাটো মুখভঙ্গি করল একটা। তারপর ননিমাধবের দিকে তাকাল।
ননিমাধব জিজ্ঞাসা করল, কাল পাটিতে গেছলে?
তাকে দেখে এই রসটা পরিবেশন করার আগ্রহেই বরুণার ঘরে ঢোকা। সোৎসাহে জবাব দিল, হা-আর, কি কাণ্ড জানেন?
ননিমাধবের চোখে কাণ্ড শোনার আগ্রহ।
বরুণা বলল, পার্টিতে সেই বাসের গুণ্ডা–সেই যে সেই–
ননিমাধব এস্তে মাথা নাড়ল, অর্থাৎ বুঝেছে। গলা নামিয়ে বরুণা হতাশ ভঙ্গিতে যোগ করল, গুণ্ডা নয়, প্রফেসার! মা অবশ্য বলে, প্রফেসারের থেকে গুণ্ডা ভাল। চেয়ারে ঠেস দিয়ে আর একটুও জুড়ে দিল, সাইকেল-রিকশঅলাও বোধহয় ভাল।
ঠাট্টায় কান না দিয়ে নমিমাধব জিজ্ঞাসা করল-মানে, সে সেখানে ছিল?
শুধু ছিল। জাঁকিয়ে ছিল।– তারপর নির্লিপ্তমুখে খবরই দিল যেন, আমাদের সঙ্গে কত খাতির হয়ে গেল, আর দিদি তো সারাক্ষণ তার সঙ্গেই গল্প-সল্প করল।
বাইরে গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ। বিজুদা হয়তো হাতের কাছে কাগজপত্র খুঁজে পায়নি। ননিমাধব মনে মনে প্রার্থনা করল, চট করে যেন না পায়, কারণ এবারের শব্দটা আর ভুল হবার নয়। বরুণাও সেই শব্দের উদ্দেশে একটা অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত করল। অর্থাৎ, ওই আসছে
ননিমাধবের হাতটা আপনা থেকেই পকেটে গিয়ে ঢুকল আবার।
অর্চনাই। দরজার কাছ থেকে এক পলক সকলকে দেখে নিয়ে হাসিমুখেই বউদির পিছনে এসে দাঁড়াল। বইখানা দেখল। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে এগিয়ে এসে ঈজিচেয়ারের হাতলের ওপরেই বসল। রানু দেবীর হুশ ফিরল এতক্ষণে।
আহা, আগুন নিভিয়ে ফেললাম?
বিব্রত হলেও রানু দেবীর চোখের সামনেই জবাব মজুত। ননিমাধবের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি মশাই, আগুন নিভেছে?
ননিমাধব বিগলিত, এর পরেই হাতের রুমাল মুখে না উঠে থাকে কি করে। দেখাদেখি বরুণাও গম্ভীর মুখে তার রুমাল বার করে মুখ মুছতে লাগল। হাসি চেপে অর্চনা কুটি করে তাকাল তার দিকে, এই–তুই ওখানে কি কচ্ছিস রে?
রুমাল নামিয়ে বরুণা ধীরে-সুস্থে জবাব দিল, কালকের পার্টিতে সেই গুণ্ডা প্রফেসারের সঙ্গে তোর কেমন ভাব হয়ে গেছে ননিদাকে সেই কথা বলছিলাম। রাগতে গিয়েও অর্চনা হেসেই ফেলল। ননিমাধব এতক্ষণে কথা বলার ফুরসত পেল।–আজ এত দেরিতে ছুটি যে?
রাণু দেবী যোগ করল, ভারি অন্যায়–।
অর্চনা হাসিমুখে ফিরে ননিমাধবকেই জিজ্ঞাসা করল, আপনার এত সকাল সকাল ছুটি যে, ফ্যাক্টরি তো পাঁচটা পর্যন্ত?
ননিমাধব জবাব হাতড়ে পাওয়ার আগেই রসভঙ্গের জবাবটি এসে হাজির। বিজন। হাতের কাছে সত্যিই কাগজপত্রগুলো না পেয়ে বিলক্ষণ বিরক্ত। তার ওপর এরা। বরুণা অবশ্য জিভ কামড়ে তৎক্ষণাৎই উঠে পড়েছে, তবু রেহাই পেল না। বিজন বলল, কাজের সময় সব এখানে কেন, বাড়িতে আর জায়গা নেই। যা পালা–
অর্চনা উঠে দাঁড়িয়ে দাদার বিরক্তি আর ব্যস্ততা নিরীক্ষণ করল একটু। তারপর টিপ্পনী কাটল, বা-ব্বা! সাইকেল-রিকশতেই এই–এরোপ্লেন হলে না-জানি কি হত!
.
বরুণা ননিমাধবের কাছে যেমন ঠাট্টাই করুক, ফাঁক পেলে এবারে সেই লোকটার সঙ্গে একটু যোগাযোগের বাসনা হয়তো মনে মনে অর্চনারও ছিল। লোকটার আচরণে মা স্পষ্টই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বলে দোষ কাটানোর জন্যে সেদিনই ইলা-মাসি তার ঢল। প্রশংসা করেছেন মায়ের কাছে। বলেছেন, আজকালকার দিনে ছেলেটি রত্ন-বিশেষ, একাড়ি টাকা খরচ করলেও এ-রকম লোক মেলে না। এর পর ইলা-মাসি যখন অনুযোগ করবেন এই নিয়ে তখন সে নাকি ভয়ানক অপ্রস্তুতও হবে। অর্চনার একটু-আধটু কৌতূহল ইলা-মাসির প্রশংসা শুনেই নয় বোধহয়… ঘরে-বাইরে-য়ুনিভার্সিটিতে ওর সামনে পুরুষের সলজ্জ বা বিব্রত মূর্তি অনেক দেখেছে। আর তাদের চোরা কটাক্ষ তো এখন আর বেঁধেও না। কিন্তু এই লোকটার রূঢ় সরলতার একটু ভিন্ন আবেদন। যে কারণে এরা সব প্রায় করুণার পাত্র, তার বিপরীত কারণেই এই লোকটির প্রতি একটুখানি বিপরীত কৌতূহল বাসে রেষারেষি করে ওর পাশে বসার পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে কোথায় দেখেছে স্মরণ করতে না পারার নিরাসক্ততাও রমণীমনের নিভৃতে একটু লেগেছিল কি না বলা যায় না। জার্চনা অন্যরকম দেখেই অভ্যন্ত। কিন্তু এইসব সূক্ষ্ম অনুভূতির ব্যাপার অবচেতন মনেই প্রচ্ছন্ন ছিল। য়ুনিভার্সিটির পথে পরিচিত বাস-স্টপের সামনে এসে এক-আধবার শুধু লক্ষ্য করেছে মানুষটাকে দেখা যায় কি না। দেখা গেলে কি করবে অর্চনা নিজেও জানে না। পর পর দুদিনের এক দিনও দেখেনি। আগে বা পরে ক্লাস থাকতে পারে, তাছাড়া মিনিটে মিনিটে বাস, দেখা না হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।