এতজনের পরামর্শের মধ্যে পড়ে মিন্টুর বাবাকেও একটু চিন্তিত দেখা গেল। তিনি বললেন, তাই তো, এ এক সমস্যা। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য একটি লোক উপস্থিত এখানে, সেটা যেন এতক্ষণ খেয়াল ছিল না। খেয়াল হতে ঘাড় ফেরালেন, মিঃ মিত্র অমন চুপচাপ কেন আপনিই তো বলবেন–
সকলের চোখ এদিকে আকৃষ্ট হতে মিন্টুর বাবা আবার বললেন, ও…একে আপনারা চেনেনা বোধহয়-প্রফেসর সুখেন্দু মিত্র-মিন্টু, যে প্রথম হতে পেয়েছে সে তো ওঁরই হাতষশ।
প্রশংসা শুনেও হাত-যশস্বী লোকটা তেমন প্রীত হয়েছে মনে হল না অর্চনার। বরুণা ফিস ফিস করে মাকে আবার বলল, গুণ্ডা নয় মা, প্রফেসর
মিসেস বাসু প্রায় আত্মগত মন্তব্য করলেন, মাস্টারের চেয়ে গুণ্ডা ভাল
সকলেরই খাওয়া শেষ প্রায়। সুখেন্দু মিত্র ঝুঁকে দেখল, মিন্টুরাও হাত গুটিয়ে বসে আছে। বাপের কথার জবাব না দিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যেই আগে বলল, তোমাদের তো খাওয়া হয়ে গেছে দেখছি মিন্টুবাবু…ভাল ভাল দুটো বই এনেছি তোমার জন্য, পড়ার টেবিলে আছে–দেখগে যাও। বন্ধুদেরও নিয়ে যাও–
এই রকম একটা অবতরণিকা অপ্রত্যাশিত। মিল্টর বেরিয়ে গেল। অভ্যাগতরা একটু যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। এইবার ছেলের বাপের দিকে ঘুরল সুখেন্দু মিত্র, হেসেই বলল, পরীক্ষায় প্রথম হওয়াটা যে বিশেষ কিছু সেটা ও এভাবে না জানলেই ভাল হত।…মিণ্ট, আই. এসি পড়বে আপাতত এর বেশী ভাবার দরকার আছে বলে তো আমার মনে হয় না।
সকলেরই একটু-আধটু অপ্রতিভ অভিব্যক্তি। কালচারের সংজ্ঞায় প্রতিবাদ সৌজন্যবিরোধী, কাজেই এ-রকম শুনতে তেমন অভ্যন্তও নয় কেউ। বরুণ প্রথমে হাঁ, তার এবারের চিমটি খেয়ে অর্চনা অস্ফুট শব্দ করে উঠল একটু। অসহিষ্ণু মিসেস বাসুর ঠোঁটদুটো একবার নড়ল শুধু। অশ্রুত উক্তি, কাজেই শোনা গেল না।
.
নিচের ঘরে টেবিলের একদিকে বসে কাগজ কলম নিয়ে নিবিষ্ট একাগ্রতায় সাইকেল-রিকশর ব্যবসা বাড়ানোর স্কীম ছকে যাচ্ছে অর্চনা-বরুণার দাদা বিজন। ব্যবসা অনেকদিনই করেছে, স্কীমও নতুন নয়। তবে এতদিনে সেটা কিছুটা পরিণতির মুখে এসেছে। টাকার আশ্বাস কিছুটা পেয়েছে। তাই স্কীম করার একাগ্রতাও বেড়েছে। তার সামনের চেয়ারে বসে তেমনি মন দিয়ে ঘরের কড়িকাঠ দেখছে ননিমাধব। বিজনের অগোচরে এক-আধবার ঘড়িও দেখছে। য়ুনিভার্সিটি চারটেয় ছুটি হলেও মোটরে বড়জোর আসতে লাগে আধ ঘণ্টা…তার মানে এখনো আধ ঘণ্টার ধাক্কা। গতকাল ছুটির দিনটা মাটি হয়েছে। ফ্যাক্টরি থেকে টেলিফোনে বরুণার অনুমতি চেয়েছিল, থিয়েটারের টিকিট কাটবে কিনা। অনুমতিটা আসলে কার দরকার সেটা বরুণাও ভালই জানে। তবু দিদিকে জিজ্ঞাসা না করেই সাফ জবাব দিয়েছে, কোন আশা নেই, কাল ইলা-মাসির বাড়িতে পার্টি।
আবার ছুটির দিন আসতে তো ছ’টা দিন…!
ঘরের কোণে ঈজিচেয়ারে গা ঢেলে দিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে একটা নতুন উপন্যাসে ডুবে আছে বিজনের স্ত্রী ইন্দ্রাণী দেবী, সংক্ষেপে রাণু বউদি। কি একটা কাজে বিজন ফ্যাক্টরি থেকে আগেই বেরিয়েছিল। ননিমাধকে বলে গিয়েছিল সে যেন সাড়ে তিনটেয় বাড়ি আসে–জরুরী আলোচনাটা সেখানে বসেই হবে। ননিমাধব সাড়ে তিনটেয় না এসে তিনটেয় এসেছিল। য়ুনিভার্সিটি তে কত কারণেই ছুটি থাকে, বরাত ভাল থাকলে আজও ছুটি থাকতে বাধা কি। বিজুদ আসব আগে আধ ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে তাহলে। কিন্তু বরাত ভাল নয়। এসে শুনল য়ুনিভার্সিটি খোলাই। বাড়িতে আর কেউ না থাকায় দাশু রাণু বউদিকে খবর দিয়েছে। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রানু দেবীকে বই হাতে করেই উঠে আসতে হয়েছে। গল্পের বই হাতে পেলে আহার-নিদ্রা ঘুচে যায় মহিলার। তার ওপর তেমনই বই এটা। আগুন, আগুন- ডবল আগুনের তাপ বোধহয় অনেকদূর পৌঁছেছে। বিজনের সাড়া পেয়ে শাস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অতিথি-আপ্যায়নের দায় শেষ করে ঈজিচেয়ারে আশ্রয় নিয়েছে। এখানেই নিরাপদ, ওপরের ঘরে ঘরে এক্ষুণি শাশুড়ী ঠাকরুণ টহল দেবেন–তার হাতে বই দেখলে সকলেরই চোখ টাটায়। অবশ্য, আবার আগুন-আগুনে ঝাঁপ দেবার আগে দাশুকে খাবার আর চায়ের নির্দেশ দিয়ে এসেছে, নইলে পাঠে বিঘ্ন ঘটবে জানা কথাই।
খানিকক্ষণ হল দুজনের সামনেই খাবার রেখে গেছে দাও। এবারে ট্রেতে চা এনে দেখে খাবারের প্লেট ছোঁয়াও হয়নি। সকলের অগোচরে একটা নীরব অভিব্যক্তি সম্পন্ন করে ব্যবসায়ী দুটিকে সচেতন করাবে আশায় দাশু যার দিকে ফিরে তাকাল–সে আরো অনেক দূরে। মলাটের গায়ে ভবল আগুন থেকে এতে দাশু এদিকেই ফিল আবার তার পর গলা দিয়ে একটা ফ্যাসফেসে শব্দ বার করে নীরবতায় ব্যাঘাত ঘটাল।
বিরক্তমুখে বিজন মুখ তুলে তাকাল।–রেখে যা।
চা রেখে দাশুর প্রস্থান। এই সুযোগে ননিমাধব নড়েচড়ে বসে খাবারের প্লেটটা কাছে টেনে নিয়ে গেল। কিন্তু হল না। বিজনের লেখার কাজ শেষ হয়েছে। ব্যবসায়ের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চিত্রটা এঁকে ফেলে টাকার অঙ্কটা মোটামুটি হিসেব করে ফেলেছে। বলল, আচ্ছা শোনো–
ননিমাধব শোনার জন্য হাত গুটিয়ে নিল।
এখন আমাদের সাইকেল-রিকশর প্রোডাকশন ডেলি ধরে। তিনটে—
ননিমাধব চিন্তা করল একটু।–সাড়ে তিনটেও ধরতে পারে।
ও সাড়ে-টাড়ে ছাড়ো–তিনটেই। আমাদের করতে হবে ডেলি কম করে দশখানা–তাহলে লোক বাড়াতে হবে অন্তত তিনগুণ, ফ্যাক্টরির স্পেস চাই দ্বিগুণ। এই মেসিনপত্রের লিস্ট–এগুলো তো আনাতেই হবে।…সব খরচা ফেলেছি দেখ, আপাতত তিরিশ হাজার টাকার নিচে হবে না। স্কীমটা নিয়ে গিয়ে তোমার বাবাকে বেশ বুঝিয়ে টাকার কথা বলো–