ইলা-মাসির বাড়ির এই পার্টিতে অর্চনা এসেছিল। স্বেচ্ছায় আসেনি, আসতে হয়েছিল। মায়ের এই সব আভিজাত্য রক্ষার ব্যাপারে বরুণা তবু পার পায় কিন্তু ও বড় পায় না। অবশ্য এবারে বরুণাও রেহাই পায়নি। বাবা আসেননি। আসবেন না অর্চনা জানতই। ইলা-মাসি খোঁজ করেছিলেন। মা জবাবদিহি করেছেন, আর বলো কেন ভাই, আসতে পারলেন না বলে তার নিজেরই কি কম দুঃখ-হঠাৎ শরীরটাই খারাপ হয়ে পড়ল।…্যাই হোক, মায়ের সঙ্গে অর্চনা আজ পর্যন্ত যত জায়গায় গেছে, তার মধ্যে এবারে এই ইলা মাসির বাড়ি থেকেই মনে মনে একটু খুশী হয়ে ফিরেছে।
ছেলের পরীক্ষার কৃতিত্ব উপলক্ষে ঘরোয়া পাটি হলেও অভ্যাগত একেবারে কম জোটাননি ইলা-মাসি। এখানে যাদের দেখল, তাঁদের সকলকেই কারো না কারো জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও দেখেছে, সাংস্কৃতিক জলসা বা নাচের আসরেও দেখেছে, আবার রিলিফ চ্যারিটি শোতেও দেখেছে। নতুনের মধ্যে শুধু মিণ্টর দু-চারজন বন্ধু-বান্ধব। কাজেই এ অনুষ্ঠানেও অভিনবত্ব কিছু ছিল না, আর অর্চনা ভাবছিল কতক্ষণে শেষ হবে, কতক্ষণে বাড়ি যাবে।
বৈচিত্র্যের কারণ ঘটল খাবার টেবিলে।
হল-ঘরে মস্ত একটা ডিম্বাকৃতি ডাইনিং টেবিল। চারদিকে গোল হয়ে বসেছেন সব। একটা ধার নিয়ে বসেছিল অৰ্চনা আর বরুণা। মায়ের হয়তো টেবিলের মাঝামাঝি বসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মেয়েরা বসে পড়েছে দেখে বরুণার পাশে এসেই বসলেন তিনি। টেবিল ঘুরে তাদের উল্টো দিকে কয়েকটা আসন খালি, কেউ তখনো আসেননি হয়তো।
খাবার টেবিলের প্রধান আলোচনা, ছেলে মিণ্ট, ভবিষ্যতে কোন্ লাইনে যাবে আর কি পড়বে। ছেলে আর ছেলের বন্ধুরাও হাঁ করে সেই আলোচনা শুনছে। বরুণার ভাল লাগছিল না, অর্চনা অন্যদিকে তাকাতেই সে টুক করে তার প্লেটের কাটলেটটা নিজের প্লেটে তুলে নিল। অর্চনা দেখে ফেলে হাসি চেপে ভ্রুকুটি করে তাকাল তার দিকে। বরুণা চাপা গলায় বলল, তুই আর একটা চেয়ে নে না।
দুই বোনে এমনই চলত বোধহয়। ঠিক সেই সময়ে নতুন আগন্তুকের আবির্ভাব। আর তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই অর্চনা প্রায় হাঁ!…বাসের সেই লোকটা। বাসের মতই তেমনি সাদাসিধে বেশ-বাস। এ-রকম পরিবেশে একেবারে বেমানান।
মিন্টুর বাবা উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন, আসুন মিঃ মিত্র, আপনি কিন্তু লেট, বসে যান–।
লেট হওয়ার দরুন মিঃ মিত্রের কিছুমাত্র কুণ্ঠা দেখা গেল না। হাসিমুখে সে মিন্টুর দিকে এগিয়ে গেল। অর্চনা বরুণার কানে কানে যোগাযোগের বৈচিত্র্যটা জ্ঞাপন করতেই সে যুগপৎ আনন্দ আর বিস্ময়ে আগন্তুকের দিকে চেয়ে দুই চোখের বিশ্লেষণের কাজটা সেরে নিল। লোকটা তখন মিন্টুর পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে।
আনন্দমিশ্রিত উত্তেজনায় বরুণা মাকে ফিসফিস করে বলল, মা-দিদির বাসের সেই গুণ্ডা।
মিসেস বাসু আগে লোকটাকে এক নজর দেখেছেন কি দেখেননি। এবারে ভাল করে দেখায় মন দিলেন। মিন্টুর কাছ থেকে এগিয়ে গিয়ে লোকটি তখন খালি আসনের একটাতে বসল। অর্চনা-বরুণার ঠিক উল্টো দিকে নয়–কিছুটা আড়াআড়ি। মিসেস বাসুর দৃষ্টিও সেখানেই এসে থামল। এ-রকম বেশভূষার একটা লোক এখানে কেন, সেটাও বোধ করি তার কাছে বিস্ময় একটু।
এদিকে অর্চনা আর বরুণাও চেয়ে আছে।
সকলের অগোচরেই ছোট্ট প্রহসনের সূচনা একটু। খাবারের প্লেট কাছে টানতে গিয়ে ওধারে অর্চনার চোখে লোকটির চোখে পড়ল। অর্চনা খাবারের প্লেটে দৃষ্টি নামাল। কিন্তু বরুণার সে কাণ্ডজ্ঞান নেই। হাঁ করে সে আর একটি দুর্লত খাদ্যবস্তুই দেখছে যেন।
খেতে খেতে লোকটি আরো দুই একবার দেখল তাদের। কিছু স্মরণ করতে চেষ্টা করছে বোঝা যায়। অর্চনার সঙ্গে আর একবার চোখাচোখি হতেই সামনের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?
ওখান থেকে ওভাবে প্রশ্ন নিক্ষেপ করা সুশোভন নয়। দুই একজন প্রৌঢ় এবং প্রৌঢ়া হাসি গোপন করে গেল। না দেখে থাকলেও দেখার লোভটা যেন স্বাভাবিক সেটা তারাও অস্বীকার করেন না। এটা তারা প্রাথমিক আলাপের চেষ্টা বলেই ধরে নিলেন। অর্চনা অতদূর থেকে হঠাৎ এ-ভাবে আক্রান্ত হয়ে বিব্রত মুখে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, মনে পড়ছে না।
মিসেস বাসু ভুরু কোচকালেন। বরুণা চাপা পুলকে দিদিকে বেশ করে চিমটি কাটল একটা।
ওদিকে টেবিলের আলোচনাটা মিন্টুর ভবিষ্যতের দিকেই ঘুরেছে আবার। এক ভদ্রলোক মিন্টুর বাবাকে পরামর্শ দিলেন, আপনি এক কাজ করুন মিঃ খাস্তগীর, বি. এ. পাস করিয়ে ওকে সোজা আই. এ. এস্-এ বসিয়ে দিন
তাঁর পাশের মহিলাটির তাতে আপত্তি। তিনি মত প্রকাশ করলেন, ও চাকরিতে আছে কি–আই, এসি, পাস করিয়ে ওকে বরং ডাক্তারি পড়তে দিন।
এ ধার থেকে এক ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন, ডাক্তারি থেকে আজকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভাল–পাস করে একবার বাইরে ঘুরে এলেই ব্রাইট ফিউচার।
বরুণা দেখল তার দর্শনীয় লোকটা খাওয়া ফেলে হাঁ করে মতামত শুনছে। পাশ থেকেই এবারে তারই মা বলে উঠলেন, আমি বলি ইলা, আই, এসি, পাস করিয়ে মিন্টুকে তুমি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংএ দিয়ে দাও। আমার সেই বোনপোকে তো জানো, ওই তো বয়েস-এরই মধ্যে কত বড় অফিসার।
নতুন কিছুই বলেছেন। মিসেস বাসু অন্তরতুষ্টিতে সকলের দিকে তাকালেন। আর শুধু বরুণা নয়, অর্চনাও দেখল, এবারে ঐ লোকটার নীরব বিস্ময় আর কৌতুকের কেন্দ্র তাদের মা।