বলতে বলতে স্বামীর দৃষ্টি অনুসরণ করে ফিরে দেখেন দরজার ওধারে অর্চনা আর বরুণা দাঁড়িয়ে। মায়ের চোখে চোখ পড়তে পড়তে বরুণা কেটে পড়ল, অর্চনা সামলে নিয়ে নিরীহ হতে চেষ্টা করল। মেয়েকে ডাকার কাজটা মিসেস বাই করলেন।–এই যে, এসে বল কি হয়েছে আজ–
অর্চনা দরজার কাছ থেকেই ঢোঁক গিলে বলল, তুমিই বলো না আমি কি আর তোমার মত করে বলতে পারব–।
ব্যাপার কিছু নয় বুঝে ডক্টর বাসু আত্মতত্বে ডুব দিতে চেষ্টা করলেন আবার। কিন্তু সেই চেষ্টার আগেই স্ত্রীটি কাগজটা নিয়ে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে রাখল।–মেয়েরা আর একদিনও ওভাবে ট্রামে-বাসে যাবে না আমি বলে দিচ্ছি।
ডক্টর বাসু বিরক্ত হলেন, গাড়ি কি নেই নাকি! তাছাড়া হাজার হাজার মেয়ে দিনের পর দিন ট্রামে বাসেই যাচ্ছে।
যে যাচ্ছে যাক, আমি জানতে চাই তুমি আর একখানা গাড়ি কিনবে কি না!
স্ত্রীর এই অবুঝপনাই ডক্টর বাসু বরদাস্ত করে উঠতে পারেন না সব সময়। উঠে বসে অসহিষ্ণু বিরক্তিতে বলে উঠলেন, কিনব কি দিয়ে, টাকার জন্যে তো দিনরাত নোট লিখে লিখে ছেলেগুলোর মাথা খাচ্ছি–তাতেও রেহাই নেই। তোমার বাড়ি, তোমার গাড়ি, তোমার শাড়ি, তোমার পাটি–
অর্চনা পালিয়ে বাঁচল। আর বরুণাকে হাতের কাছে পেয়ে সত্যিই গোটাকতক কিল বসিয়ে দিল গুমগুম করে।–পাজী মেয়ে, তোর জন্যেই তো
কিলগুলো খুব আস্তে পড়েনি, তবু সেগুলি হজম করে বরুণা হেসে গড়াগড়ি।
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হবার কথা, কিন্তু উদ্দেশ্য নিয়ে ওপরওয়ালা যে যোগাযোগ ঘটান, সেটা সুদূরপ্রসারীও হয়।
বাড়ির গাড়িতে যুনিভার্সিটি যাবার পথে অর্চনা বাস-স্টপে সেই একরোখা লোকটাকে বাসের অপেক্ষায় একগাদা বই হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে পর পর আরো দুদিন। এক পথেই যায়, আর লোকটা এক জায়গা থেকেই ওঠে যখন, দেখতে পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। অৰ্চনা একদিন ভেবেছে, এই বয়সেও কলেজে পড়ে নাকি! আর একদিন ভেবেছে, মোটরে তুলে নিলে কি হয়? কিন্তু একা সাহস হয় না, বরুণা থাকলে ঠিক মজা করা যেত। বরুণার কলেজ বাড়ির কাছেই, সে অনেক আগেই নেমে পড়ে। তা বলে সত্যিই লোকটার সম্বন্ধে তেমন কোন কৌতূহলই ছিল না–ওই দেখার মুহূর্তটুকু যা।
কিন্তু কৌতূহলের কারণ ঘটল একদিন।
বাবার ঘরে বসে সেদিন সন্ধ্যায় অর্চনা তার কি একটা লেখা নকল করে দিচ্ছিল। মা-ও ছিলেন ঘরে। বাবার ট্রাক খুলে ব্যাঙ্কের পাস-বইয়ের জমা খরচ দেখছিলেন। টেলিফোন বেজে উঠতে বাবা টেলিফোন ধরলেন। কথাবার্তায় মনে হল বাবা কারো স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষার খবর শুনে খুণী হয়েছেন। অর্চনার মনে পড়ল, ইলা-মাসীর ছেলে মিন্টু, এবারে স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা দিয়েছে বটে। ইলা-মাসী বাবার ব্যারিস্টার বন্ধুর জী, মারে অন্তরঙ্গ বান্ধবী। অর্চনা-বরুণারও যাতায়াত আছে সেখানে।
টেলিফোনে কিছু শুনেই বাবা যেন থমকে গেলেন। বিব্রত কণ্ঠ কানে এলো, অ্যাঁ? পা-পার্টি-হ্যাঁ, নিশ্চয় নিশ্চয়, কবে?
মায়ের কানে কিছুই যায়নি বোধ হয় এতক্ষণ, পাটি শুনে ঘাড় ফেরালেন। তারপর ইশারায় জানতে চাইলেন, কে?
বাবার মুখভাব বদলেছে, কিন্তু মুখে খুশীর ভাবই প্রকাশ করেছেন। মায়ের ইশারার জবাব না দিয়ে ফোনের জবাবটাই শেষ করলেন, খুব ভাল কথা, তা আপনি বরং আমার স্ত্রীর সঙ্গেই পরামর্শ করুন–(হাসি) হা–আমি তো তার ওপরেই সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি, ধরুন একটু
মিসেস বাসু ততক্ষণে কাছে উঠে এসেছেন। টেলিফোনের মুখটা চেপে তার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে ডক্টর বাসু সংক্ষিপ্ত উক্তি করলেন পার্টি
অর্চনার মজা লাগছিল, পাছে বাবার চোখে চোখ পড়ে যায় সেই জন্য তাড়াতাড়ি মুখ নামালো। টেলিফোনে মায়ের আনন্দটুকু আরো উপভোগ্য। মিন্টু, স্কুল ফাইন্যালে একেবারে প্রথম হয়েছে শুনে একটু একটু আনন্দ প্রকাশ করলে চলে! আর সকলে মিলে আনন্দের ব্যবস্থা একটু? তা তো করতেই হবে, ওকে এনকারেজ করতে হবে না! সে-জন্যে ভাবনা কি, কিছু ভাবনা নেই–সব ঠিক হয়ে যাবে। উনি?
এবারে বাবার কথা বোধহয়। বাবা বইয়ে মন দিয়েছেন। অর্চনা ঘরে আছে তাও মায়ের খেয়াল নেই বোধ হয়। বাবার হয়ে একেবারে নিশ্চিন্তে কথা দিয়ে দিচ্ছেন, আর বাবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ—হ্যাঁ, নিশ্চয় যাবেন, নিজে কতবড় স্কলার। জানো তো, এসব ব্যাপারে ওঁর খুব উৎসাহ! মেয়েরা একবার একটু খারাপ রেজাল্ট করলে ওঁর ভয়ে আমি সুদ্ধ চুপ–।
অর্চনার হাসি সামলানো দায়। চেয়ে দেখে বাবাও ওর দিকে চেয়ে হাসছেন। মা টেলিফোন রেখে বিছানায় বসলেন। দরজার ওধারে চোখ পড়তেই ডাকলেন এই দাশু, শোন–
দাশু ঘরে এসে দাঁড়াল।
দাদাবাবু কি করছে?
দাশু নির্বিকার জবাব দিল, ব্যবসা কচ্ছেন—
কি–? মায়ের বিরক্তি।
দাশু ব্যাখ্যা করে বোঝালো, নিচে দাদাবাবু আর ননিবাবুতে বসে কাগঞ্জে ব্যবসা লিখছেন।
মায়ের মাথায় অনেক ভাবনা। হুকুম করলেন, গিয়ে বল, আমি ডাকছি–
দাও চলে গেল, মা ঘুরে বসলেন বাবার দিকে।– শুধু হাতে তো আর যাওয়া যায় না, ছেলেটাকে একটা ঘড়িই দেওয়া যাক। বিজন গিয়ে দেখেশুনে আজই নিয়ে আসুক। কি বলো?
বই রেখে বাবা চুরুটের বাক্সর দিকে হাত বাড়ালেন। বইয়ের সাইজের সুন্দর একটা কাশ্মীরী কাজ-করা কাঠের বাক্সে চুরুট থাকে। ভয়ে ভয়ে অর্চনা বাক্সটা বাবার দিকে এগিয়ে দিল। মুখ বন্ধ করার জন্যই যেন তিনি আস্ত একটা চুরুট নিজের মুখগহ্বরে ঠেলে দিলেন।