দ্বিতীয়বার আর টিকা টিপ্পনী শোনা গেল না। লোকটি পিছনের দিকে একবার সরোষে চোখ বুলিয়ে নিয়ে যেন চ্যালেঞ্জের মাথাতেই অর্চনার পাশে বসে পড়ল আবার। এইভাবে পঁড়ানো তাকানো আর আবার বসার অর্থ খুব স্পষ্ট। অর্থাৎ অমন ইতর উক্তি আর কানে এলে ফলটা খুব ভাল হবে না।
অর্চনা সবিস্ময়ে এক-একবার আড়ে আড়ে দেখছে লোকটাকে, তার এই জিদ করে বসাটাও খুব অপছন্দ হয়নি যেন।
বাড়ি এসে বরুণাকে বলেছিল কাণ্ডটা। ভাইবোনের মধ্যে বরুণাই ছোট সব থেকে। আই. এ পড়ে, কিন্তু ইয়ারকিতে টইটুম্বুর। অর্চনা অবশ্য খুব নীরস করে বলেনি বাসের গুণ্ডাগোছের ভদ্রলোকের কাণ্ডটা।
বরুণা আকাশ থেকে পড়েছে, গুণ্ডাগোছের ভদ্রলোক কি রে! তারপর গম্ভীব মুখে জেরা করেছে বেছে বেছে সে তোর সীটের গায়ে গিয়েই দাঁড়িয়েছিল কেন-বাসে আর লেডিস সীট ছিল না?
তিলকে তাল করতে বরুণার জুড়ি নেই। প্রথম সুযোগেই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সমাচারটা শোনাল ননিদাকে। দাদার বন্ধু এবং সাইকেল রিকশর ব্যবসায় পাটনার ননিমাধব। দাদার থেকে বয়সে কিন্তু ছোট হলেও দাদার অসম্ভব একনিষ্ঠ ভক্ত। কিন্তু আসল ভক্ত কার, এবং দাদা বাড়ি থাক বা না যখন তখন বাড়ি এসে বসে থাকে কোন প্রত্যাশায়, সেটা অর্চনাও যেমন জানে ননিদাও তেমনি জানে। অর্চনাকে দেখলেই তার ফর্সা মুখ লাল হয়। আর পকেট থেকে রুমাল বেরোয়। আর তার সামনা-সামনি কোন লজ্জার কারণ ঘটলে ( দিদির সামনে লজ্জার কারণটা বেশির ভাগ বরুণাই ঘটিয়ে থাকে। রুমালের ঘষায় ঘষায় ননিমাধবের ফল। মুখ রক্তবর্ণ হয়। দাদার সাময়িক অনুপস্থিতির ফাঁকে তার কাছেই করুণা প্রথম দু-চোখ কপালে তুলে বাসের মধ্যে দিদিকে গুণ্ডায় ধরার ব্যাপারটা নিবেদন করেছে।
কিন্তু বরাতক্রমে সেখানে যে মা এসে পড়বেন সে কি বরুণা জানত। এসে যখন পড়েছেন তাকেও সানন্দে ঘটনাটা না বলে পারল না, আর এখানে গুণ্ডা গোছের ভদ্রলোক না বলে শুধু গুণ্ডাই বলল। শোনার সঙ্গে সঙ্গে মা যেমন উত্তেজিত তেননি ক্রুদ্ধ। প্রথমে অর্চনার উদ্দেশেই হাঁকডাক করলেন এক প্রস্থ। অৰ্চনা তখন নিজের ঘরে বসে বরুণার উদ্দেশ্যে কিল জমাচ্ছে। ওদিকে ননিমাধব ইন্ধন যোগালো আরো। মন্তব্য করল, ট্রামে-বাসে আজকাল ভদ্রলোকের মেয়েদের চড়াই উচিত নয়।
হাতের কাছে আর কাউকে না পেয়ে মিসেস বাসু তাকেই দিলেন এক ধা। –তোমরা তো ব্যবসাই করছ দেখি বছরের পর বছর, একটা গাড়ি পর্যন্ত কিনে উঠতে পারলে না–ট্রামে বাসে না চড়ে কিসে চড়বে?
ননিমাধব আর ভরসা করে বলতে পারল না যে গাড়ি একটা আছেই।
গাড়ির জন্য স্বামীকে নতুন করে এক প্রস্থ ঝালিয়ে নেবার সুযোগ ছাড়লেন না মিসেস বাসু। অর্চনাকে ছেড়ে আপাতত তার উদ্দেশেই চললেন।
দোতলার কোণের দিকে একটা ঘরে থাকেন ডক্টর বাসু। তার ডক্টরেক্টর বিষয়বস্তু দর্শনশাস্ত্র। অবশ্য ইংরেজিতেও এম এ, ভদ্রলোক, কিন্তু দর্শনেরই যে প্রভাব বেশি সেটা তার অবিরাম চুরুট-খাওয়া মূতি আর ঘরের আগোছালো অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। একদিকে অবিন্যস্ত শয্যা, তারই ওপর স্থূপীকৃত বই–র্যাকের বইগুলো উলট-পালট-টেবিলেও বইয়ের গাদা আর বইপত্র ছড়ানো। তারই মধ্যে কখনো বিছানায়, কখনো বা টেবিলে-চেয়ারে বসে দিব্বি নিবিষ্ট মনে কাজ করে যান ভদ্রলোক। শুধু অর্চনা ছাড়া কেউ আর এই সব বইপত্র ছুঁতেও সাহস করে না। সপ্তাহের মধ্যে কম করে তিনদিন বাবার ঘর গোছায় অৰ্চনা আর অনুযোগ করে, কবে হয়তো দেখব তুমি বই চাপা পড়ে আছ
বইপত্রের মধ্যেই আধশোয়া হয়ে আত্ম-তত্ত্বের একটা ইংরেজী প্রবন্ধ পড়ছিলেন তিনি। আর মনে মনে ভাবছিলেন, অর্চনা যদি এসে থাকে তাকে পড়ে শোনাবেন। বাবার কাছে বসে এই শোনার ধকলটা অর্চনাকে মুখ বুজে সইতে হয়। সয়ও, কারণ রিটায়ার করার পর আর সময় কাটে না, বেচারা বাবা করবেনই বা কি সারাক্ষণ। কিন্তু ওর বদলে যিনি এলেন, ভদ্রলোকের আত্মতত্ত্বোপলব্ধির মেজাজটা রসাতলে গেল।
মিসেস বাসু ঘরের বাইরে থেকেই কণ্ঠস্বরে আগমন ঘোষণা করতে করতে এলেন।–কতদিন বলেছি একটা গাড়িতে চলে না, চলে না–আর একটা গাড়ি কেনো! একটা বিপদ না বাধলে আমার কথা কি কানে যাবে।
ডক্টর বাসু আত্মতত্ত্ব থেকে মুখ তুলে বুঝতে চেষ্টা করলেন কি ব্যাপার, তারপর নিস্পৃহ মুখে জবাব দিলেন, কথা কানে গেলেই তো আর গাড়ি কেনা যায় না, টাকা লাগে
টাকা লাগে, টাকা লাগবে। এই এক অজুহাত আর যেন বরদাস্ত করতে রাজী নন মিসেস বাসু। মেয়েটা ধেই-ধেই করে ট্রামে-বাসে যাক আর যতসব পাজী গুণ্ডার খপ্পরে পড়ক, কেমন?
ডক্টর বাসু অবাক, ট্রামে-বাসে গুণ্ডা!
মাকে গজগজিয়ে বাবার ঘরের দিকে যেতে দেখেই তাল সামলাবার জন্যে অর্চনাকেও মায়ের অগোচরে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াতে হয়েছে। পিছন থেকে তার গা ঘেষে বরুণাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মা সামনের দিকে মুখ করে আছেন, কিন্তু বাবা দেখতে পাচ্ছেন তাদের। অর্চনা ইশারায় হাত নেড়ে বাবাকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করল ব্যাপারটা কিছুই নয়।
স্বামীর অজ্ঞতায় মিসেস বাসু প্রায় হতাশ। জবাব দিলেন কোথায় কি সে জ্ঞান যদি তোমার থাকত তাহলে আমার আর ভাবনা ছিল কি। মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে দেখ কি হয়েছে আজ