…সামনে একটা জালি দোলায়…হিজিবিজি কি-সব জড়ানো তাতে…শত সহস্র, হাজার হাজার!
…সেই জালিদেয়ালের সামনে থেকে, সেই অবাক-চোখ মুসলমান বুড়োর কাজ থেকে, সেই প্রাসাদসৌধের ওপর দিয়ে সেই সিঁড়ি ধরে যে মেয়েটা তরতরিয়ে নেমে আসছে–সে ও নিজেই। সিঁড়ি সিঁড়ি সিঁড়ি সিঁড়ি–সিঁড়ি যেন আর ফুরোয় না। কলকাতা কতদূর?
ঈজিচেয়ারেই ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসল অর্চনা।
…ওটা শেষের অঙ্ক। শুরু ছিল। তারও অনেক আগে…
অস্পষ্টতার আবরণ ভেদ করে জনাকীর্ণ কলকাতা শহরের সদর রাস্তায় একটা দোতলা বাস স্পষ্ট হয়ে উঠল হঠাৎ।
শুরু সেইখানে।
৩. বাসে করেই য়ুনিভার্সিটি
০৩.
ফাঁক পেয়ে অর্চনা সেদিন বাসে করেই য়ুনিভার্সিটি যাচ্ছিল।
মা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন তাঁর সামাজিক কর্তব্য পালনে। সময়মতই ফিরবেন বলে গিয়েছিলেন। অর্চনা ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, তার পরেই বেরিয়ে পড়েছে। বাসে করে যেতে তার একটুও খারাপ লাগে না। মারের কচকচির জন্য কলের পুতুলের মত গাড়িতেই যেতে হয় বেশির ভাগ। কিন্তু ফাঁক পেলে ছাড়েও না। দশজনের ব্যস্তসমস্ততার মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে এ-ভাবে যেতে শুধু ভাল লাগে না, বেশ আত্মনির্ভরশীলতার বোধটুকুও জাগে।
অথচ অবস্থা তাদের এমন কিছু ভাল নয়। যেটুকু দেখায় সে শুধু মায়ের কেরামতিতে। ঠাট বজায় রাখার জন্য বাবা বেচারীকে এ-বয়সেও কম খাটতে হয় না। পেনসানের পর শুধু বড় বই ক’টার আয়েও চলছে না-স্বনামে বে নামে আরো এটা সেটা লিখতে হয়ই। বাবা বলেন, এই সব আজে-বাজে শর্টকাট আর নোট লিখে ছেলেগুলোর মাথা খাওয়া হচ্ছে। বাবা চেষ্টা করলেও আজে-বাজে লিখতে পারেন এটা অবশ্য অর্চনা বিশ্বাস করে না। কিন্তু খুশী মনে যে লেখেন না সেটা বোঝা যায়। না লিখে উপায় কি, প্রিন্সিপালের আর কতই বা পেনসান–তাছাড়া মায়ের যা তাগিদ! একটা গাড়িতে আর চলে না, মেয়েদের অসুবিধে নিজের অসুবিধের ফিরিস্তি দেন ফাঁক পেলেই। বাবার সঙ্গে একটু আধটু লেগেও যায় এই নিয়ে। অর্চনাকেও মা খুব রেহাই দেন না, এই আদরিণী মেয়ে যদি বাপকে গিয়ে ধরে আর একটা গাড়ির জন্যে, তাহলে হয়তো কিছুটা এগোয়। গাড়ির জন্যে একটা কিছু নতুন বই লেখা খুব অসম্ভব বলে তিনি মনে করেন না। অর্চনা মাকে খুশী করার জন্যেই বাবাকে আচ্ছা করে বলবে বলে আশ্বাস দেয়। আর বাবাকে বলে, মায়ের সঙ্গে কিছু কথা কাটাকাটি কোরো না, যা বলে বলুক না, একটা গাড়ি আছে এই বেশি-আমরা অনায়াসে ট্রামে-বাসে যাতায়াত করতে পারি। বাবাকে আবার সাবধানও করে দেয়, আমি বলেছি বোলো না যেন মাকে, তাহলে দেবে শেষ করে–।
যে-বাসে যাওয়া নিয়ে মায়ের এই আপত্তি, সেই বাসেই আজ এক মন্দ মজা হল না।
অফিস টাইম। দোতলা বাসেও ঠাসাঠাসি ভিড়। বাইরে লোক ঝুলছে, ভিতরেও বহু লোক দাঁড়িয়ে। একটা লেডিস সীটে অর্চনা একা বসে, পাশের জায়গাটুকু খালি। ঠিক তার পরেই এক হাতে মাথার বড় ধরে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক, অন্য হাতে বুকের সঙ্গে ঠেকানো এক গাদা বই। লম্বা-চওড়া চেহারা, সাদাসিধে বেশভূষা। পিছনের চাপে ভদ্রলোকের দাঁড়াতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে বোঝা যায়, এক-একবার টাল সামলানো দায় হচ্ছে।
অর্চনা এক একবার ভাবছে বসতে বলবে, আবার বলছে থাকগে বাবা দরকার নেই, সে-দিনের মত হয় যদি–।
আগে সীট খালি থাকলে এবং কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে বসতেই বলত। আর যাকে বসতে বলা, তার কৃতার্থ ভাবটাও দিব্বি উপভোগ করত। কিন্তু সে দিন কি কাণ্ড, মাগো! ভয়ানক মোটা এক ভদ্রলোকের দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল দেখে বসতে বলেছিল। ভদ্রলোক ইচ্ছে করেই হোক বা সত্যি বেশি মোট বলেই হোক-অর্চনার প্রাণান্ত অবস্থা। জানালার সঙ্গে একেবারে মিশে গিয়েও শান্তি নেই। আর কোন দিকে না তাকিয়েও অর্চনা বুঝতে পারছিল বাসসুদ্ধ লোক মজা দেখছে। এমনিতেই তো যেদিকে তাকায় জোড়া-জোড়া চোখ গায়ে বিধে আছে দেখে!
সেই দিনই অর্চনা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে আর কক্ষনো কাউকে পাশে বসতে বলবে না…তাছাড়া এই ভদ্রলোকও তেমন মোটা না হোক, হৃষ্টপুষ্ট কম নয়–আর হাবভাবও কেমন রুক্ষ-রুক্ষ। এক-একবার বেশ রাগ-রাগ ভাবেই তাকাচ্ছে খালি জায়গাটুকুর দিকে।
কিন্তু অতগুলো বই নিয়ে লোকটির দাঁড়ানো মুশকিল হচ্ছিল ঠিকই। বাস যত এগোচ্ছে, অফিসযাত্রীর ভিড়ও বাড়ছে, আর সেই অনুযায়ী ভারসাম্য রক্ষার ধকলও বাড়ছে। শেষে একটা জোরে ধাক্কা খেয়ে অর্চনার পাশে ধুপ করে বসেই পড়ল সে। অর্চনা ফিরে তাকাল।
কিছু মনে করবেন না, দাঁড়ানো যাচ্ছিল না–।
অর্চনা কিছু না বলে আর একটু ব্যবধান রচনার চেষ্টা করল।
কিন্তু বাসের লোকগুলোর ধরনই আলাদা। ট্রামে উঠলে অন্যরকম। থাকেও কত রকমের লোক! ভিড়ে চ্যাপটা, কিন্তু রসিকতাটুকু আছে। পিছন থেকে একটা ছোকরা টিপ্পনী কেটে উঠল, দাদা, ওটা লেডিস সীট—
কিছু না বলে লোকটি শুধু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল একবার। অর্থাৎ সেটা জেনেই বসা হয়েছে।
বাসে ফাজিল লোকের অভাব নেই। রসিকতার লোভে ঝগড়াটা যেন আর একজন সেধে নিল। দাঁড়ানো যাচ্ছিল না দেখে দাদা বসেছেন, তাতে আপনার মাথাব্যথা কেন মশাই, লেডিস সীট লেড়ি বুঝবেন
সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের পাঁজা নিয়েই লোকটি উঠে দাঁড়াল এবং টাল সামলাবার জন্য অন্য হাতে রডটা ধরে বক্তার খোঁজে ফিরে তাকাল। রড ধরা হাতের ঢোলা পাঞ্জাবিটা নেমে আসতে তার পেশীবহুল পুষ্ট বাহুখানা অনাবৃত হল। অর্চনা বেশ ভয়ে ভয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে।