নিজের ভাষাপ্রয়োগের বহরেই হয়তো হেসে উঠলেন। তার পর উৎসুক দুই চোখ ওর মুখের উপর রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, বলো তো পাঠিয়ে দিই তোমার কাছে–পাঠাবো?
নীরব দৃষ্টি-বিনিময়। তার পর হঠাৎই অর্চনা হাসল একটু। বড় নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে কি ভেবে নিল খানিক। তখনো হাসছে একটু একটু। শেষে খুব সহজভাবেই বলল, আচ্ছা পাঠাবেন।
আনন্দে কল্যাণীদি বুঝি জড়িয়েই ধরবেন তাকে। কিন্তু আনন্দের মুখেও থমকেই গেলেন, ভরসা করে ঠিক যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না– সত্যি বলছ?
যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে অর্চনা বলল, হ্যাঁ–। সন্ধ্যে হয়ে গেল, আসি–
সেই রাতেই নিখিলেশ এসেছে! আসবে অর্চনা জানত। দাশুর হাত জোড়া, কড়া নাড়ার শব্দ শুনে ও নিজেই শান্ত মুখে দরজা খুলে দিল। আসুন।
যেন প্রতীক্ষাই করছিল। তবু নিখিলেশ বিব্রত বোধ করেছে একটু। দিদি কেন যে তাকে এক রকম ঠেলেই পাঠালো খুব স্পষ্ট নয়। বলল, অসময়ে বিরক্ত করলাম না তো?
না, বিরক্তি কিসের, আসুন।
ধরে নিয়ে এলো তাকে। নিখিলেশ আবারও বলল, আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে দিদি এমন তাড়া লাগালো যে–
জানি। বসুন–। অর্চনারই কোন দ্বিধা বা জড়তা নেই। এমন দ্বিধাহীন সহজ তাকে কোনদিন দেখা যায়নি। বরং যে এলো তার সঙ্কোচ লক্ষ্য করেই যেন হাসিমুখে বলল, দিদি তাড়া না দিলেও আসতে কোন বাধা নেই, কল্যাণীদির ভাই আপনি, আপনাকেও আপনজন ভাবতে ইচ্ছা করে।
নিখিলেশ অবাক হবে কি খুশী হবে ভেবে পাচ্ছে না।
অর্চনা খাটের একধারে বসল।–চা খাবেন একটু?
অসুবিধে না হয় তো আপত্তি নেই।
অসুবিধে কিসের–। উঠে দাশুকে দু পেয়ালা চায়ের কথা বলে আবার এসে বসল।–দাশুর চায়ের জল আর মেজাজ দুই-ই সবসময়ে চড়ানো থাকে। এখন আপনি আছেন, মেজাজ দেখাতে পারবে না।
নিখিলেশ হেসে বলল, অনেক কাল আছে শুনেছি।
অনেক কাল। তাকে ঘাড়ে চাপিয়ে বাবা আমাকে জব্দ করেছেন।
আলাপের আর একটা সুতো পেল নিখিলেশ–আপনার বাবাকে খুব দেখার ইচ্ছে, দু-বছরেও হল না।
বেশ তো, একদিন চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি, একেবারে সাদা মানুষ–
শোনার সঙ্গে সঙ্গে চকিতে অর্চনার সাদা বেশবাসের দিকে চোখ গেল নিখিলেশের। ইতিমধ্যে দাশু চা নিয়ে হাজির। অর্চনা উঠে এক পেয়ালা তার হাতে দিয়ে অন্য পেয়ালাটা নিজে নিয়ে বসল। দাশু চলে গেল।
চুপচাপ পেয়ালায় দু-চারটে চুমুক দিয়ে নিখিলেশ জিজ্ঞাসা করল, আজ দিদির ওখানে গেছলেন নাকি?
হ্যাঁ… আপনার কথাও শুনলাম—
আমার কথা?
দিদি বললেন, আপনি কাজের মানুষ অথচ আজকাল কাজকর্ম কিছু করেন না, আমিই নাকি উপলক্ষ।
নিখিলেশ যেমন বিব্রত, তেমনি অবাক। এই অর্চনা বসুকেই কি সে এত দিন দেখে আসছে!–দিদি বলেছে এ কথা?
বলেছেন। আপনাকে ভালবাসেন বলেই বলেছেন। কত বড় ভবিষ্যৎ আপনার সামনে, যে-কোন দিদিই বলবেন।–আপনার চা জুড়িয়ে যাচ্ছে।
নিখিলেশ পেয়ালা তুলে নিল। হঠাৎ কণ্ঠস্বরের পরিবর্তনে একটু হকচকিয়েই গেছে সে।
অর্চনা তার পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে খুব সহজ অথচ শান্ত মুখে বলল, আপনাদের এই ইস্কুলে কাজ করছি এটা আমার কাছে কতবড় পাওয়া আমিই জানি। এ আমি হারাতে চাইনে।
নিখিলেশ বিস্মিত।–এ কথা কেন?
জবাবে দুই এক মুহূর্ত চুপ করে রইল অর্চনা, তার পর একটু হেসেই ফিরে বলল, কিছু যদি না মনে করেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
নিখিলেশ নির্বাক জিজ্ঞাসু।
আপনার বয়েস কত?
নিখিলেশ প্রায় বিমূঢ়। অস্ফুট জবাব দিল, বছর ঊনতিরিশ-তিরিশ… ।
অর্চনা মাথা নাড়ল।–আমিও সেই রকমই ভেবেছিলাম। হাসল একটু, আমার ছত্তিরিশ। এম. এ. পড়তে পড়তে মাঝখানে কয়েক বছর পড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম।
হতভম্বের মত নিখিলেশ চেয়েই আছে। জীবনে এমন একটা বিস্ময়ের মুহূর্ত আর আসেনি বোধ হয়।
অর্চনা একটু থেমে খুব সাদাসিধে ভাবেই বলে গেল, কল্যাণীদি ঠিক বুঝতে পারেননি, আমি কোন হতাশা নিয়ে বসে নেই– বরং নিজেরই ভুলের খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত করছি।…হাসতে চেষ্টা করল আবারও, আপনি বিদ্বান বুদ্ধিমান, আপনাকে আর বেশি কি বলব।
.
রাত বাড়ছে। ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার। খুব দূরে মাঝপ্রহরের শিয়াল ডেকে উঠল কোথায়। অর্চনা খাটে ঠেস দিয়ে বসে আছে। নিঃশব্দে একটা যাতনার নিষ্পেষণ ভোগ করছে।
উঠে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল। সামনে আবছা নিস্তরঙ্গ গঙ্গা। ভিতরের যাতনাটা বাড়ছেই। মালীর ছেলেটা ডুবতে ডুবতেও ডাঙা খুঁজেছে অর্চনার সেই খোঁজার আকুতিও গেছে! সরে দেয়ালের তাকের কাছে এসে দাঁড়াল। ঘুমের ওষুধ। না থাক–।
ওষুধের শিশি রেখে দিয়ে ঘরের ঈজিচেয়ারটা অর্ধেকটা বাইরের বারান্দায় টেনে এনে বসল। বাইরে ঘোলাটে অন্ধকার। আকাশে নিশীথিনীর স্তব্ধ সভায় তারাদের মূক উৎসব।
অর্চনা ভাবছে কিছু। ভাবছে না, কিছু যেন মনে পড়ছে। নতুন করে জন্ম হল ব্যথার, তার অব্যক্ত আর্তস্বর ছড়িয়ে পড়ছে ফেলে আসা জীবনের আনাচে-কানাচে। তারাই ভিড় করে আছে। বেদনার্ত আলোড়ন একটা। চোখের সামনে আবছা ভেসে উঠছে কিছু। দূরে, অনেক দূরে…।
…সারি সারি বিশাল সিঁড়ি আর সিঁড়ি। প্রায় আকাশ-ছোঁয়া।
…তার শেষে ইতিহাসকালের বিরাট এক প্রাসাদের আভাস।
…সেখানে এক অতিবৃদ্ধ মুসলমানের মূর্তি। শণের মত ধপধপে পাকা চুল পাকা দাড়ি বাতাসে উড়ছে…মুখ নেড়ে কিছু বলছে সে।