ছাই নতুন করে জ্বলবে কত। অর্চনা এক সময় উঠেছে। চুপচাপ চাকরির ইস্তফা-পত্র লেখা শেষ করে টেবিলে চাপা দিয়েছে। তার পরেও বিনিদ্র কাটেনি।
কুঁজোতে জল ছিল, তাকে ওষুধের ট্যাবলেট মজুত ছিল।
সকালে সহজে মাথা তুলতে পারেনি। দাশু ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙিয়েছে। চা খেতে খেতে অর্চনা ভাবতে চেষ্টা করল, রাতে ক’টা ট্যাবলেট খেয়েছিল। টেবিলের ওপর ইস্তফা পত্রটা চোখে পড়ল। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তার পর খুব শান্তমুখে সেটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ল।
দুটো দিন কোনরকমে চুপ করে ছিলেন কল্যাণীদি। তার পর ভরসা করে থাকতে পারেননি। কেমন করে যেন বুঝেছিলেন, আর দেরি করলে একেবারে দেরি হয়ে যাবে। হাসি-তামাসায় অতিবড় স্তব্ধতার ধর্মও ভাঙতে পারেন তিনি, কিন্তু এখানে সেই চেষ্টাটাই যেন বিড়ম্বনা বিশেষ। সেদিন ছুটির পর স্কুল-ফটক পেরিয়ে অর্চনার হাত ধরলেন।–ওদিকে নয়, আজ আমার বাড়ি।
আজ থাক—
কাল তো তুমি আরো একটু দূরে সরবে। আজই এসো, কথা ছিল—
তার দিকে চেয়ে অর্চনা অপেক্ষা করল একটু। তার পর চুপচাপ সঙ্গে চলল।
যদি আবারও আপত্তি করত বা দু-কথা জিজ্ঞাসা করত কল্যাণীদি কিছুটা স্বস্তি বোধ করতেন। জোর-জুলুম ঝগড়া ঝাঁটি পর্যন্ত করা চলত। কথা কিছু সত্যিই ছিল কি না তিনিই জানেন। বাড়ি ফিরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোন কথার ধারকাছ দিয়ে গেলেন না। হৈ চৈ করে জলযোগের ব্যবস্থা করলেন, অর্চনাকে সঙ্গে নিয়ে পশু-পাখির তদারক করলেন একপ্রস্থ। কোন্ পাখির জন্য নতুন খাঁচা তৈরি করতে হবে, কোন্ খরগোশটার বজ্জাতি বাড়ছে দিনকে দিন, ময়নাটার খাওয়া কমেছে, ডাকও ছেড়েছে–অসুখ-বিসুখ করবে কিনা কে জানে, কাকাতুয়াটার একটা জোড় খুঁজছেন, পাচ্ছেন না–ফলে বেচারী একেবারে মনমরা হয়ে আছে, ইত্যাদি সমাচার শেষ করে শেষে ঘরে এসে বসলেন।
এর পরেও কল্যাণীদি অৰ্চনার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে একটা কথাও তুললেন না। স্কুলে যা নিয়ে এমন কানাকানি সেই বিসদৃশ ব্যাপারেও তাঁর যেন কৌতূহল নেই। দু-পাঁচ কথার পর হঠাৎ নিজের কথাই জিজ্ঞাসা করলেন। খুব হালকা করে বললেন, আচ্ছা এই যে স্কুলে আঁকিযুকি আর বাড়িতে এই সব নিয়ে দিব্বি কাটিয়ে দিচ্ছি—কেমন আছি বলো তো আমি?
জবাবে অর্চনা তাঁর দিকে চেয়ে শুধু হাসল একটু। কল্যাণীদি এ-কথাটাই বলতে চান, না আর কিছু বলতে চান–হয়তো বলবেনও। তবু কল্যাণীদিকে বরাবরই যেমন ভাল লাগে আজও তেমনি লাগছে–বড় মিষ্টি লাগছে। ক্ষত যদি খোঁজেনও, জ্বালা-জুড়ানো প্রলেপ লাগানোর জন্যেই খোঁজেন।
বেশ আছি, না?…হাসিমুখে নিজেই জবাবটা দিয়ে নিলেন।–সকলেই বলে দিব্বি আছি। ব্যাপার কিছু আছে সকলেই জানে, জেনেও ভাবে বেশ কাব্যের মত কাটিয়ে দিচ্ছি। অথচ আমার দশা ভাবো একবার, সময় পার করে দিয়ে এখন কাকাতুয়ার জোড়া খুঁজে বেড়াচ্ছি।
ছোট মেয়ের মতই খিলখিল করে হেসে উঠলেন কল্যাণীদি, যেন খুব মজার কথা কিছু। তার পর বলে গেলেন, অথচ কত কাণ্ড করে শেষে এই দশা ভাবো–বর্ণে অমিল বলে কাকা আর মা একজনকে বাতিল করে দিলেন, আর অমন বর্ণের মিলটা তাঁদের চোখে পড়ল না সেই রাগে আমি কাকার গার্জেন-গিরিই নাকচ করে দিলাম, আর মা যে নিজের মা নয় সৎ-মা সেটাও তাঁকে বুঝিয়ে আসতে ছাড়লাম না। তার পর ওই এক বর্ণে অন্ধ হয়ে বসে রইলাম, অথচ চোখের ওপর দিয়েই কত বর্ণ চলে গেল তাকিয়ে দেখলামও না একবার। কি লাভ হল বলো তো? কেউ কি বসে থাকল, দিন কি থেমে রইল–নিজেই শুধু নিজেকে নিয়ে বসে রইলাম। বিচ্ছিরি, বিচ্ছিরি–
অৰ্চনার আর ভাল লাগছে না, ফাঁপর ফাঁপর লাগছে। চিকিৎসকের আন্তরিকতা সত্ত্বেও ক্ষতের ওপর ভুল ওষুধ পড়লে যেমন লাগে। কিন্তু কল্যাণীদি নিজের ঝোঁকেই বলে যেতে লাগলেন, অথচ যা হয়েছে সেটা মেনে নিলেই এক রকম না এক রকম করে ঘা শুকাতো–তা না, উজানেই সাঁতার কেটে গেলাম। কেউ পারে?
অর্চনা বলল, এসব কথা থাক কল্যাণীদি—
থাকলে চলবে কেন, কল্যাণীদি মাথা নাড়লেন, দুঃখ যেমনই হোক, জীবন ছাড়া জীবনের ফাঁক ঘোচে না রে ভাই–মেয়েদের তো নয়ই। এই বুড়ো বয়সেও আমার সংসার করতে সাধ যায়, আমার বাপু পষ্ট কথা। আমাকে নিয়ে ওরা তোমার মত অমন হাসাহাসি কানাকানি করলে মুখের ওপর বলে দিতাম। আমি আর পাচ্ছি কাকে বলো–কিন্তু তোমার সামনে কেউ আছে কিনা একবার চোখ তাকিয়ে দেখবে না?
অর্চনা এতক্ষণে আভাস পেলো কি বলতে চান কল্যাণীদি। ইস্কুলে ওই সদ্য রটনার ফলে নানা সংশয়ে এদিক থেকে আপনজনের বরং পিছপা হবার কথা। ঈষৎ বিস্ময়ে অর্চনা চুপচাপ চেয়েই রইল তার দিকে।
আসল বক্তব্যে পৌঁছে কল্যাণীদির আর রাখাঢাকা নেই। বললেন জল-ঝড়ের দিনে সেই যেদিন প্রথম দেখলাম, সেই দিনই তোমাকে ভাল লেগেছিল। … আমারই ভাই তো, ভাল দেখলে ছেলেটারও ভাল লাগার চোখ– তার দোষ কি বলো?
অর্চনা চেয়েই আছে। আরো শান্ত, আরো একটু নিষ্প্রাণ।
কল্যাণীদিও লক্ষ্য করছেন আর ভিতরে ভিতরে দমে যাচ্ছেন একটু। তবু, মুখের কথা বার করেছেন যখন শেষ না দেখেই ছাড়বেন না। হাসলেন আবারও, চুপ করে গেলে কেন, কথা তো তোমার আমার মধ্যে হচ্ছে!…একটু থেমে বললেন, নিজের ভাই–কত আর বলা যায়, তোমার দুঃখ ও কোনদিন ছোট করে দেখবে না–ঠিক আমার বাবার স্বভাবটি পেয়েছে। তোমার কথা ভেবে ছোঁড়াটা নিজের অনেক কাজকর্মে ঢিলে দিয়েছে জেনেও এতদিন কিছু বলিনি, আজ আর না বলে পারছি না। নেড়েচেড়ে দেখই না দু-দিন–ভাল লাগতেও তো পারে।