আনন্দে দু-হাতে ছেলেটাকে আবার সামনে তুলে ঝাঁকাতে গিয়ে থমকে গেল। কলরব শুনে ময়দা ফেলে হাস্যবদন দাশু একবার উঁকি দেবার লোভ সামলাতে পারেনি। তারই সঙ্গে চোখোচাখি। অর্চনা গম্ভীর হতে চেষ্টা করল, সঙ্গে সঙ্গে দাশুও গম্ভীর মুখে নিজের কাজে ফিরে গেল।
মালা ছবির খোঁজে টেবিলের সেই বিলিতি মাসিকপত্রের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অর্চনাদির কাণ্ডকারখানা দেখছে আর হাসছে মুখ টিপে। এখন তার আপসোস হচ্ছে খুব, কেন আর দুটো দিন আগে এলো না। ভরসা পায়নি বলেই আসেনি, আজও খুব ভয়ে ভয়েই এসেছিল।
অর্চনা ছেলেটাকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল। ঝাঁকাল, আদর করল, তাকের ওপর থেকে বিস্কুট দিল তার হাতে। ভাল বিস্কুট মজুতই থাকে ওর জন্য। তার পর মুখোমুখি ওকে বুকের কাছে এনে বলল, তুই দুষ্টু–
ছেলেটার তাতে আপত্তি, বিস্কুটে কামড় বসিয়ে ভাঙা ভাঙা পাল্টা জবাব দিল, তুমি ডুট্টু–
উঁহু, আমি ভাল।
তুমি মন্ন—
আর তুই?
আমি বা-ব্বু–
ভিতরে ভিতরে অর্চনার কি যেন আলোড়ন একটা। সুখের মত আবার ব্যথার মতও। ছেলেটার মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, আর আমি?
ছেলে বিস্কুটে কামড় বসিয়ে জবাব দেবার ফুরসত পেল না।
কিন্তু হঠাৎ হল কি অৰ্চনার? কি যে হল নিজেও জানে না। স্থান কাল ভুল হয়ে গেল। মুখের ভাব বদলাতে লাগল। একটা অব্যক্ত আকুতি বুক ঠেলে ওপরে উঠছে। চোখে মুখে অস্বাভাবিক অগ্ৰহ কিসের। দশ বছরের মেয়েটা ছবি ফেলে হাঁ করে চেয়ে আছে খেয়াল নেই!
আবারও ছেলেটার গালের কাছে, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল অর্চনা, আমি মা। মা–
বিস্কুট ভুলে শিশুটি এবার ঘাড় ফিরিয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকাল তার দিকে। আর তিমির তৃষ্ণায় তাকে যেন একেবারে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাইল অর্চনা। ছেলেটা ধড়ফড় করছে হুঁশ নেই। কণ্ঠস্বরে অস্ফুট আকুতি।–মা বল। মা বল! মা বল–
বিভ্রান্ত উত্তেজনার মুখেই সম্বিৎ ফিরল।
লজ্জায় বেদনায় সঙ্কোচে অর্চনা নিস্পন্দ, বিবর্ণ একেবারে। নিভৃতচারী বাসনার এমন মূর্তি এমন করে নিজেও বোধকরি আর দেখেনি কখনো। সেই লজ্জার ব্যথা নিজের কাছেই দুর্বহ, তার ওপর ওই মেয়েটা বিস্ফারিত বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে তাকে। দশ বছরের মেয়ে মালা–শুধু দেখছে না, কেমন ভয়ও পেয়েছে।
ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি বুকের থেকে নামিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। থালায় খাবার নিয়ে দাশু ঘরে ঢুকেছে। ব্যস্তসমস্তভাবে অর্চনা থালাটা তার কাছ থেকে প্রায় কেড়ে নিয়েই মালার সামনে রাখল।–নাও, খেয়ে নাও! আমি আসছি–
দাশুর পাশ কাটিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দাশু অবাক। মেয়েটার খাবার তো সে এনেছিলই!
খেয়েদেয়ে ভাই কোলে করে মালা হৃষ্ট চিত্তেই ঘরে ফিরেছে। কিন্তু অর্চনাদির এমন নতুন কাণ্ডটা মাকে না বলে পারেনি সে। কাণ্ড বলে কাণ্ড, একেবারে তাজ্জব কাণ্ড!
দুই এক কথাতেই তার মা তাজ্জব কাণ্ডের মূলসুদ্ধ বুঝে নিলেন। তারপর খপ করে মেয়ের চুলের মুঠি ধরে কয়েক প্রস্থ ঝাঁকানি দিলেন বেশ করে। পাজী মেয়ে, রোজ নাচতে নাচতে তোর ওখানে যাওয়া চাই কেন? ফের যদি ওকে নিয়ে আবার ও-মুখো হতে দেখি মেরে একেবারে হাড় গুঁড়ো করে দেব।
অপরাধ সম্বন্ধে সচেতন নয় বলে মেয়েটা দ্বিগুণ হতভম্ব।
রবিবার সমিতির মধ্যহ্নে-আসরে মালার মা চুপি-চুপি শিক্ষয়িত্রী প্রভা নন্দীর কানে তুললেন কথাটা। ঘটনাটা জানিয়ে অনুযোগ করলেন, কেমন টিচার ভাই আপনাদের, চেহারা-পত্র তো ভাল, টাকাও রোজগার করে–বিয়ে-থা করলেই তো পারে।
প্রভা নন্দী সেই বিকেলেই ছুটেছেন মীরা সান্যালের বাড়ি। এতবড় বিস্ময়ের বোঝা একা বহন করবার নয়, বাসি করতেও মন চায় না। পরদিন টিচার্স-রুমের কানাকানিতে কান পাতলেন সকলেই। এমন কি সহকারী হেডমিসট্রেস স্মৃতি করও। শেষে কাজের অছিলায় উঠে গিয়ে হেডমিসট্রেস মালতী রায়ের ঘরে ঢুকলেন তিনি।
শিক্ষয়িত্রীদের হাবভাবে স্পষ্ট ব্যতিক্রমটা অর্চনার চোখে পড়তে সময় লাগেনি। অর্চনা যেন এতকাল ঠকিয়ে এসেছে তাঁদের। দূরে সরে থেকে একটা আলগা মর্যাদা আদায় করেছে। নতুন করে নতুন চোখে দেখতে শুরু করেছেন তাঁরা ওকে। অনাবৃত কৌতূহলে রহস্যের কিনারা খুঁজেছেন।
শুধু কল্যাণীদি ছাড়া। কিন্তু তাঁর মমতাভরা দুই চোখেও কি এক নির্বাক জিজ্ঞাসা।
অর্চনা হঠাৎ বুঝে ওঠেনি।
কিন্তু বুঝতে সময়ও লাগেনি।
অস্বস্তির বোঝা একটা অনড় হয়ে বুকে চেপেই ছিল। সেই দিনই বিকেলের দিকে হেডমিসট্রেস ওকে নিজের ঘরে ডেকে দুই একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রয়োজনের কথা বলে নিয়ে শেষে খুব মিষ্টি করে বলে দিলেন মেয়েদের একটু বেশি প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে–অতটা করা ঠিক ভাল নয়, অর্চনাকে তিনি স্কুলের গৌরব মনে করেন বলেই কথাটা বললেন–ইত্যাদি।
অর্চনা বুঝেছিল, তার পরের ক্লাসে মালার চোখে চোখ রাখার সঙ্গে সঙ্গে। অন্য মেয়েগুলোর চোখে-মুখেও দুর্বোধ্য বিস্ময় আর কাঁচা কৌতূহল।
অর্চনা না বসু কি নিজের মৃত্যু কামনা করেছে সেদিন?
কিছুই করেনি, কিছুই করতে পারেনি। ক্লাস ছিল আরও একটা, তাও শেষ না করে আসেনি। বাড়ি ফেরার পর দাশু খাবার এনে সামনে ধরেছে তাতেও আপত্তি জানায়নি।
রাত গড়িয়েছে। দাশুও বিদায় নিয়ে গেছে।