উপলক্ষ, মালীর ওই কচি ছেলেটার জলে ডোবা। সেই থেকেই সূচনা।
কয়েকটা দিন মূক বেদনায় অর্চনা দিনরাত ছটফট করেছে শুধু। দিনের সেই ছটফটানি ইস্কুলের মেয়েরা কিছুটা টের পেয়েছে। দশ বছরের মালা ক্লাসের ক্লাস-মনিটার। অর্চনাদির ক্লাসে সে পর্যন্ত সহপাঠিনীদের টুঁ-শব্দটি বরদাস্ত করতে পারেনি। নোটবই হাতে নিয়ে মেয়েদের ধমকেছে, এই, একেবারে চুপ সব, নাম টুকবো কিন্তু! অর্চনাদির ক্লাস না এখন? জানিস সেই দিন থেকেই কেমন হয়ে আছেন–
অনুশাসন শেষ হওয়ার আগেই অর্চনা ক্লাসে ঢুকেছে।
কিন্তু রাতের খবর শুধু একজন রাখে। দাশু। দাশুর বয়স হয়েছে, মেজাজটা সব সময় বশে থাকে না। এর দ্বিগুণ ধকল সামলাতেও আপত্তি নেই তার, কিন্তু এই গুমোট আর এত অনিয়ম বরদাস্ত হয় না। গত রাতেও বেশ পষ্টপষ্টি একপশলা হয়ে গেছে এই নিয়ে।
ট্রেতে এক পেয়ালা চা নিয়ে নিঃশব্দ রাগে ঘরে ঢুকে দেখে বই হাতে দিদিমণি খাটে ঠেস দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে বসে আছে। সে চা নিয়ে ঢুকেছে তাও টের পেল না। ছোট টেবিলের দেয়াল-তাকের কাছে ট্রে টেবিলে রাখতেই তাকের ওপর সারি সারি ট্যাবলেটের শিশিগুলোর ওপর চোখ গেল দাশুর। কম করে পাঁচটা, চার-পাঁচ রকমের। এই তিন চার দিনে কোন শিশি থেকে ক’টা ট্যাবলেট কমেছে একবার চোখ বুলিয়ে তাও বলে দিতে পারে। ক্ষুব্ধ রাগে দাশু একে একে সব ক’টা শিশিই চায়ের ট্রেতে নামিয়ে এনেছিল। তার পর সেই ছোট টেবিল সুদ্ধ তুলে এনে বিছানার পাশে ঠক করে রেখেছিল।
অর্চনার হুঁশ ফিরেছে। চায়ের সঙ্গে ট্রেতে ওষুধের শিশিগুলো দেখে জিজ্ঞাসু নেত্রে দাশুর দিকে তাকাতে সে বলেছে ঘুমোবার ওষুধ খাবে কি জেগে থাকবার ওষুধ খাবে কে জানে–সব ক’টাই এনে দিলাম।
ঈষৎ বিরক্ত মুখে অর্চনা চায়ের পেয়ালা তুলে নিয়েছিল। পরের অভিযোগটা দাশু ঘরের দেয়ালকেই শুনিয়েছে যেন।–সন্ধ্যে থেকে চার পেয়ালা হল, বলো তো চাল ক’টাও চায়েতেই সেদ্ধ করে দিতে পারি।
অর্চনা অন্যদিন হলে হাসত, একটু তোশামোদও করত হয়তো। তার বদলে শুধু বিরক্তই হয়েছে। কিন্তু মেজাজ দাশুরও তেমনি চড়া তখন। তাক থেকে টাইমপীস ঘড়িটা এনে সশব্দে সেটাও টিপয়ের ওপর বসিয়ে দিয়েছিল। রাত তখন দশটার কাছাকাছি।
তুমি যাবে এখান থেকে?
যাব–। বলেই অদূরের টুলটা একেবারে খাটের কাছে টেনে এনে গ্যাঁট হয়ে বসে জবাব দিয়েছে, একেবারেই যাব। কিন্তু এখন তুমি কি করবে জেনে যাই।
ছেলেবেলায় অনেক শাসন করেছে, হম্বি-তম্বি করেছে, এখন আর অতটা সম্ভব নয় বলেই আপসোস যেন।
আঃ, দাশুদা!
দাশুর গলা একটু নেমেছে বটে, কিন্তু ক্ষোভ যায়নি। বলেছে, জীবনভোর তো মেজাজের ওপরেই কাটালে, তার ফলে তো ওই–! ওষুধের শিশিগুলো একসঙ্গে সাপটে হাতে তুলে নিয়েছিল সে।–কালই আমি এগুলো গঙ্গায় দিয়ে আসব।
গঙ্গার বদলে আপাতত সেগুলি তাকের ওপরে রেখেই গজগজ করতে করতে প্রস্থান করেছে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে সত্রাসে অর্চনা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ ফিরিয়েছে। চাঁদের আলোয় রাতের গঙ্গা চকচক করছিল।
পরদিন।
অর্চনাকে ইস্কুল থেকে ফিরতে দেখেই দাশু ময়দা মাখতে বসেছিল। খাবে না বলার অবকাশ দিতে রাজী নয় সে। তার দু-হাত জোড়া। বাইরের দরজায় ঠকঠক শব্দ।
অত্যন্ত বিরক্ত হয়েই দাশু উঠে এসে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে দরজার হুড়কো খুলে দিল।
বাইরে দাঁড়িয়ে মালা, কোলে তার দেড় বছরের ফুটফুটে ভাইটা। দেখেই দাশু বেজায় খুশী। এদের দেখে এমন খুশী শিগগির হয়নি বোধহয়।– তোমরা।
আনন্দাতিশয্যে হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে আদর করতে গিয়ে খেয়াল হল, হাতে ময়দা মাখা। উৎফুল্লমুখে অভ্যর্থনা জানাল, এসো এসো–। যেন বহুপ্রতীক্ষিত অথচ অপ্রত্যাশিত কেউ এসেছে। হঠাৎ বাচ্চা ছেলেটার একেবারে মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, এই ক’টা দিন কি কচ্ছিলে চাঁদ। ওদিকে যে–
থেমে গিয়ে মালার উদ্দেশে তাড়াতাড়ি বলল, যাও যাও, ভিতরে যাও—
ভাইকে নিয়ে মালা ভিতরে ঢুকল। দাশুর মুখে প্রসন্ন হাসি।
ইস্কুল থেকে ফিরে মুখ হাত ধুয়ে অর্চনা চায়ের প্রতীক্ষা করছিল। কিন্তু শুধু চা চাইলে আবার দু-কথা শুনতে হবে বলেই কিছু বলে নি। টেবিলের ওপর বিলিতি মাসিকপত্র উল্টে আছে একটা। মলাটের বিজ্ঞাপনে উজ্জ্বল প্রাণবন্ত এক শিশুর ছবি। অন্যমনস্কর মত অর্চনা চুপচাপ সেটাই দেখছিল। পায়ের শব্দে ফিরে তাকাল।
মালার কোলে ছেলেটাকে দেখে হঠাৎ যেন ভারি খুশী হয়ে উঠল সেও। ক-দিন ধরে অনড় বোঝার মত যে অনুভূতিটা বুকে চেপে আছে, সেটা একেবারে ঝেড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করল। এক ঝলক জীবন্ত আলো দেখে যেন ক’টা দিনের এক দুঃসহ আচ্ছন্নতার ঘোর কাটিয়ে ওঠার তাড়নাই অনুভব করল হঠাৎ।
একগাল হেসে এগিয়ে এসে ছেলেটাকে মালার কাছ থেকে লুফে নিল প্রায়। একবার মাথার কাছে তুলে, দুবার ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, ওরে দুষ্টু, তুই এসেছিস।
অর্চনার সাদা চশমাটার ওপর ছেলেটার বরাবরই বড় লোভ। প্রথম সুযোগেই খপ করে সে টেনে ধরল সেটা।
এই দস্যি, ছাড় ছাড়!
চশমাটা নিয়ে আছড়ে ভাঙলেও অর্চনা অখুশী হত না বোধহয়। ছেলেটাকে বুকের কাছে ধরার সঙ্গে সঙ্গে একটা গুমোট যাতনা হালকা হয়ে হয়ে একেবারে যেন নিঃশেষে মিলিয়ে যাচ্ছে। চশমাটা ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে টেবিলের ওপর রেখে দিল। বেজায় খুশী। প্রায় অস্বাভাবিক রকমের খুশী।