সেই সময় শোভা ধরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে কিছু না কিছু বলবেনই তিনি। বলবেন, বাচ্চাগুলোর সঙ্গে আপনাকে দেখলে মনে হয় যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে ওরা।… আরো জোরালো ঠাট্টাও করেছেন, বলেছেন, আপনি নিজেই একটা কিণ্ডারগার্টেন খুলে বসুন, অনেক বেশী লাভ হবে। কি ছাই চাকরি করছেন!
বিব্রতমুখে অর্চনা পাশ কাটায়, ব্যবধানের আবরণ মুখে নেমে আসে। L
এর উপর মালীর ছেলেমেয়ে দুটোর সঙ্গে সেই সম্প্রতি দেখে প্রথমে তো চক্ষুস্থির সকলের। তার পর ফিসফিস, কানাকানি। মীরাদি প্রভাদিকে ঠেলেন, প্রভাদি মীরাদিকে। রোগ সম্বন্ধে প্রতিভাদির কানে কানে রোগনির্ণয় করেন শোভাদি। এমন কি সহকারী হেডমিসট্রেস স্মৃতি করও হালকা বিস্ময় জ্ঞাপন করেন হেডমিসট্রেস মালতী রায়ের কাছে।
কিন্তু শিক্ষয়িত্রীদের মধ্যেও একজনের কিছু কাছাকাছি এসে গেছে অর্চনা। ড্রইং টিচার কল্যাণীদির। সেটা তার নিজের চেষ্টায় নয়, কল্যাণীদির স্বভাবে। নিজেই হুড়মুড়িয়ে তার বাড়ি এসেছেন যখন তখন, বাচ্চাদের অত আদর দেওয়া নিয়ে মন-খোলা ঠাট্টা করেছেন, আবার নিজের বাড়িতেও জোর করেই ধরে নিয়ে গেছেন ওকে। অর্চনার ভাল লাগত, এর পর নিজেই যেত তার বাড়ি, জোর করতে হত না। অনেক সময় অবাক হয়ে ভেবেছে, কাকার সঙ্গে ভাইয়ের সঙ্গে কেন নিজের বাড়িতে থাকেন না কল্যাণীদি। সুন্দরী না হলেও কুৎসিত নন, কেন বিয়েই বা করেননি…। তাঁর ছোট্ট বাড়িটা যেন ছোটখাটো চিড়িয়াখানা একটা। খাঁচায় খাঁচায় কাকাতুয়া, টিয়া, ময়না, বুলবুল হীরামন–একগাদা রঙবেরঙের খরগোশ, হাঁস, পায়রার ঝাঁক, রঙচঙা জারের মাছ–কত কি! এদের সামলাতে গিয়ে কল্যাণীদি স্কুলেও লেট হন এক-একদিন।
প্রথম প্রথম অবাক হয়ে অর্চনা তাঁর পশুপাখির সেবাযত্ন দেখত। ভালও লাগত। কিন্তু এখানে আসায়ও ছেদ পড়েছে শিগগিরই। এলেই আর একজনকে দেখত। কল্যাণীদির ভাইকে। বিকালের দিকে দিদির কাছে একবার অন্তত আসেই নিখিলেশ। আড়াল থেকে ভাইয়ের উদ্দেশে দিদির ছদ্ম অনুশাসন আর বিদ্রূপও কানে আসত। কিন্তু অর্চনার কাছে তাঁর মুখে ভাইয়ের প্রশংসা যেন ধরে না। ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে দুচোখ তাঁর সজল হতেও দেখা গেছে।
ফেরার সময় কল্যাণীদি ভাইকে বলতেন ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। প্রথম প্রথম অর্চনা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি, নিখিলের গাড়িতেই ফিরেছে। তার পর কিছু একটা অজুহাতে এড়িয়ে গেছে। কখনো বলেছে পরে যাবে, কখনো বলেছে হেঁটে যাবে। কল্যাণীদি বুঝেছেন, বুঝেই আর সে-রকম ব্যবস্থা করেননি। তবু আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে অর্চনা, কখনো-সখনো কল্যাণীদি একেবারে স্কুল থেকে ধরে নিয়ে এলে আসে।
কল্যাণীদি বলতে ছাড়েননি, কি ব্যাপার বলো দেখি তোমার, এ ভাবে থাকো কেন?
আর কেউ হলে অর্চনা জবাব না দিয়ে শুধু চেয়েই থাকত। এখানে একটু হেসে বলেছিল, আমিও যদি আপনাকে ফিরে এ কথাই জিজ্ঞাসা করি?
কল্যাণীদি অবাক হতে চেষ্টা করেছিলেন প্রথম, ও মা, আমার আবার কি দেখলে?…তার পর হেসেই জবাব দিয়েছেন, আমার কথা ছেড়ে দাও, সাধের কাজল পরতে গিয়ে চক্ষু হল কানা–তোমার কি?
অর্চনার বাধা অনুমান কবে নিখিলেশ দিদিকে বলেছে, তোমার এখানে আসার রুটিনটা আমি না-হয় রাত্রিতেই করে নেব এবার থেকে–ভদ্রমহিলাটিকে বলে দিও।
কল্যাণীদি সত্যিই বলেছেন। হাসতে হাসতেই বলেছিলেন। অর্চনা শুনে মনে মনে দুঃখিত হয়েছে, কিন্তু কিছু বলতে পারেননি।
এর পর নিখিলেশের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কমই হয়েছে তার। ইস্কুলের গত বার্ষিক উৎসবে নিখিলেশ অবশ্য ওর বাড়িতেই এসেছিল আর নিজেদের বাড়িতে ধরেও নিয়ে গেছে। প্রতি বছর ওই একটা দিন ইস্কুলে আড়ম্বর করে উৎসব হয়, আর রাত্রিতে সব শিক্ষায়ত্রীদের সেক্রেটারির বাড়িতে নেমন্তন্ন থাকে। অর্চনা ইস্কুলের উৎসবে উপস্থিত ছিল কিন্তু বাড়িতে যায়নি। নিখিলেশ গাড়ি নিয়ে একেবারে বাড়িতে হাজির।–আপনার না যাওয়াটা সকলে এত বেশি লক্ষ্য করেছেন যে না এসে পারা গেল না। চলুন–
অর্চনা আপত্তি করতে পারেনি। আপত্তি করতে গেলে পাঁচ কথা বলতে হয়, পাঁচটা, অনুরোধ উপরোধ শুনতে হয়–তাতেই সঙ্কোচ বেশি। তাকে আসতে দেখে বিজ্ঞানের টিচার আর মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী শোভা ধর প্রতিভা গাঙ্গুলীর কানে কানে ফিসফিস করেছেন, এই জন্যেই অপেক্ষা করছিল…।
একটানা দিনযাপনে এই কানাকানি ফিসফিস আর কৌতূহল অনেকটাই থিতিয়ে এসেছিল। ইস্কুলের সেই বার্ষিকী রাত্রির পর কল্যাণীদিও বাড়ি যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়েছে, দু-চার দিনের অনুযোগের পর কল্যাণীদিও বলা ছেড়েছেন। মেয়েদের বাড়িতে ও ভাবে প্রশ্রয় দেওয়াটাও সকলেই একরকম সয়ে গেছে– দেড় বছরের ভাই কোলে মালার আগমন প্রায় নৈমিত্তিক। শুধু মালীর ওই ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে বেশি বেশি করতে দেখলই নিজেদের মধ্যে যে দু-চার কথা বলাবলি করতেন সহ-শিক্ষয়িত্রীরা, টাকাটিপ্পনী হয়তো।
এমন একটানা কেটে যেতে পাবত কানে।
কিন্তু কাটল না।
ছোট্ট একটা মর্মন্তুদ ঘটনা থেকে অর্চনা বসুর এই একটানা বিচ্ছিন্নতার বাঁধ ভেঙে সহসা অকরুণ কৌতূহলের এক বন্যা এলো যেন।
আলেয়ার আলো দু-হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরতে গিয়েছিল, মায়ার প্রলোভনে নিজেকে উদঘাটিত করে বসেছে। করে ধরা পড়েছে…।