একটানা অনেকক্ষণ চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে নিখিলেশই প্রথম কথা বলল। আজকের এই জলটা আপনাদের খুব অসুবিধেয় ফেলেছে।
অর্চনার কুণ্ঠা একটুও কমেনি। মৃদু জবাব দিল, আপনার খুব কষ্ট হল–
না, আমি বেরুতামই।
নিজের পদমর্যাদা সম্বন্ধে নিখিলেশ যথেষ্ট সচেতন। তাই চুপচাপ গাড়ি চালিয়েছে অনেকক্ষণ। চাকরিটা যে এরই হয়েছে সেটা কাকা বা দিদির মুখে নিশ্চয়ই জেনেছে। ভেবেছিল, মহিলা ইস্কুল সম্বন্ধে দু-পাঁচ কথা জিজ্ঞাসা করবে বা একটু অনুগ্রহ দেখাবে। ওর পদমর্যাদার আবরণ সরানো তাহলে সহজ হত। কিন্তু কথা শুরু করেও আলাপ করা সহজ হল না। পার্শ্ববর্তিনী আবারও চুপ একেবারে।
কিন্তু অর্চনা ভাবছে অন্য কথা। ভাবছে না, মনে মনে অবাক হচ্ছে সে। আসার সময় স্টেশন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে এসেছিল। কিন্তু তাও এতক্ষণ লেগেছিল বলে মনে হয় না। জলের দরুন অনেকটা ঘোরাপথে চলেছে কি না বুঝছে না। আরো খানিক চুপ করে থেকে শেষে জিজ্ঞাসা করে ফেলল, স্টেশন কি অনেক দূর নাকি?
না। স্টেশন অনেকক্ষণ ছাড়িয়েছি।
বিস্মিত নেত্রে অর্চনা এবারে সোজাসুজি ফিরে তাকাল তার দিকে। এবারে নিখিলেশও অবাক। আমরা তো কলকাতায় যাচ্ছি, দিদি বলেনি আপনাকে?
অর্চনা ঘাড় নাড়ল শুধু। বলেন নি। মুখ দেখেই বোঝা গেল আবারও বিব্রত হয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্যবস্থাটাও মনঃপূত হয়নি। স্কুল-কমিটির গণ্যমান্য সদস্যের পক্ষে সেইটুকুই হজম করা শক্ত। নিখিলেশ বলল, আমাকে প্রায়ই কলকাতা যেতে হয়, আপনি অসুবিধে বোধ করেন তো এখনো স্টেশনে পৌঁছে দিতে পারি, আমি অবশ্য কলকাতা যাবই–।
এবারে অর্চনা লজ্জা পেল একটু। বলল, না, চলুন।
কলকাতায় পৌঁছে তার নির্দেশমত বাড়ির দরজায় গাড়ি দাঁড় করাল। বাড়ির সামনের নেমপ্লেটে চোখ আটকাল নিখিলেশের জিজ্ঞাসা করল, ডক্টর গৌরীনাথ বসু আপনার কে হন?
দরজা খুলে অর্চনা নেমে দাঁড়িয়েছে। মৃদু জবাব দিল, বাবা। আপনি চেনেন?
চিনি নে, তবে অনেককাল তাঁর বই মুখস্থ করতে হয়েছে।
প্রায় নিস্পৃহ মুখেই অর্চনা জিজ্ঞাসা করল, আপনি বসবেন না একটু?
না আজ আর বিরক্ত করব না, নমস্কার—
গাড়িতে স্টার্ট দিল। দেখতে দেখতে গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল। অর্চনা কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সাদর অভ্যর্থনা জানালে আসত বোধহয়। কিন্তু সে-ভাবে ডাকেনি। ডাকতে চায়ওনি।
.
যথাসময়ে নিয়োগপত্র এসেছে, স্কুলের কাজও শুরু করেছে। আড়াইখানা ঘরের একটা বাড়ি সেক্রেটারিই ঠিক করে দিয়েছেন।
কিন্তু অর্চনার সেই প্রথম দিনের বিচ্ছিন্নতা ঘোচেনি। টিচাররা তো এক রকমই দেখে আসছেন তাকে। সেই ধপধপে সাদা বেশবাস আর সেই সাদাটে ব্যবধান। সহ-শিক্ষয়িত্রীরা প্রথম প্রথম দলে টানতে চেষ্টা করেছেন, শেষে দেমাক ভেবে নিজেদের মধ্যে আড়ালে-আবডালে টিকাটিপ্পনী কেটেছেন। প্রতিভাদির সঙ্গে শোভাদি, আর মীরাদির সঙ্গে প্রভাদি। এখানকার মহিলা সমিতিটির সঙ্গে যোগ আছে প্রায় সকল মহিলারই। শুধু শিক্ষয়িত্ৰী নয়, বহু মধ্যবিত্ত এবং বড়লোকের ধনীরাও ছুটির দিনে সেখানে নিয়মিত আসেন এবং জটলা করেন। কল্যাণীদি তো বলতে গেলে পাণ্ডাই একজন। অর্চনার কাছে সেখান থেকেও তলব এসেছে। অর্চনা সভ্যা হয়েছে, চাঁদাও দিয়ে আসছে নিয়মিত–কিন্তু যোগ নেই।
কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে মেয়েদের সঙ্গে বিশেষ করে একেবারে ছোট মেয়েদের সঙ্গে সেই ব্যবধান ঘুচে যেতে দেখা গিয়েছিল। ছুটির দিনে দলে দলে মেয়েদের পাতা পেতে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোটাও প্রায় নিয়মে দাঁড়িয়েছিল। এর জের সামলাতে হত প্রৌঢ় চাকর দাশুকে। বলা বাহুল্য সে খুব খুশী হত না। কলকাতায় প্রথম অর্চনাদের বাড়িতে আসে যখন, অর্চনা তখন ফ্রক পরত। এখানে অর্চনার চাকর বলতেও সে, পাঁচক বলতেও সে, আর অভিভাবক বলতেও সে-ই। বাড়তি সওদা নিতে এসে মুদী-দোকানের বুড়ো মাখন শিকদারের কাছে সে রাগে গজগজ করত এক-একদিন। –তোমরা তো ভাল বলবেই, সওদা তো আর কম বিক্রি হচ্ছে না– তা যেও একদিন নাতনীকে নিয়ে, দিদিমণির যত্ন-আত্তিটা নিজের চোখেই দেখে এসো। বাচ্চা-কাচ্চা দেখলে তেনার আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না, নাতনীকে শিখিয়ে পড়িয়ে তিনিই ইস্কুলের যুগ্যি করে নেবেন।
অর্চনাদির কাছে নিজেদের কদর মেয়েরাও বুঝত। তাই অসময়ে গিয়ে হাজির হতেও বাধত না। লাগোয়া বাড়ির মালা মেয়েটার বয়েস মাত্র দশ, পড়ে ক্লাস সিক্স-এ। তার দেড় বছরের থপথপে ভাইটাকে নিয়ে অর্চনাদি যা করে, দেখে ওই ছোট মেয়েরাও মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে আর হাসে। দু দিন তাকে না দেখলে দাশুকে দিয়ে ভাইসুদ্ধ মেয়েটাকে ডেকে পাঠায়। আর বাড়ির জলখাবার মনের মত না হলে মেয়েটাও ভাই-কোলে এসে হাজির হয়। একা এসেও দেখেছে, কিন্তু ভাইকে নিয়ে এলেই লাভ বেশী।
শিক্ষায়ত্রীদের পক্ষে এতটা বরদাস্ত করা সহজ নয়। অনেক সময় সামনা সামনি ঠেস দিতে ছাড়েন না তাঁরা। বিশেষ করে বিজ্ঞানের টিচার আর মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী শোভা ধর। ক্লাস শুরু হবার আগে ইস্কুল প্রাঙ্গণে কিণ্ডারগার্টেনের বাচ্চাগুলো রোজই একদফা হুটোপাটি করে ছেকে ধরে অর্চনাকে। গল্পের বায়না করে। অর্চনার মুখে আর সে গাম্ভীর্য দেখা যায় না তখন। আদর করে কারো গাল টিপে দেয়, কারো রিবন ঠিক করে দেয়, কারো বা ঘামে-ধুলোয় জবজবে মুখ নিজের রুমালে করে মুছে দিতে দিতে বলে, খুব দুষ্টুমি করা হয়েছে বুঝি, উঁ–?