অন্য দু-তিনজন টিচার ঘুরে বসে সরাসরি নিরীক্ষণ করেছেন তাকে। আর আনন্দের উত্তেজনা কল্যাণীদির কণ্ঠস্বরে। বিস্ময়ভরা চ্যালেঞ্জ গোছের।– তাহলে আপনার চাকরি হবে না কেন?
ঈষৎ বিব্রত মুখে অর্চনা বলেছে, হবে না কেউ তো বলেননি–।
কল্যাণীদি লজ্জা পেলেন। বললেন, কেউ বলেনি অবশ্য, আমারই মনে হচ্ছিল। ইন্টারভিউ থেকে এসেই যে-ভাবে আকাশ দেখছিলেন, ভাবলাম, এখানে যা হবার হয়ে গেছে, ভালয় ভালয় বাড়ি ফিরতে পেলে বাঁচেন।
তাঁর মুখের দিকে চেয়ে অৰ্চনা আবারও হাসল একটু। ভদ্রমহিলার ওই বয়সের সঙ্গেও যেন সরল তারুণ্যের আপস দেখল। তাঁর অভিযোগটুকুও স্বীকারই করে নিল সে, তাই তো ভাবছিলাম, এ জল শিগগির থামবে না বোধহয়–
বোধহয় কেন, আজ আর মোটেই থামবে না। আকাশ-বার্তাটি যেন কল্যাণীর দৃষ্টি-দর্পণে–আপনি তো যাবেন কলকাতায়?
অর্চনা মাথা নাড়ল।
তাহলে তো মুশকিল। এখানে কেউ নেই আপনার?
না–। বলতে যাচ্ছিল, স্টেশন পর্যন্ত কেউ যদি একটা গাড়ি ডেকে দেয়–। বলা হল না। বাইরের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল। এই জলে কারো পক্ষে বেরুনোও সম্ভব নয়। কালীবর্ণ আকাশের ভাববিকার নেই।
কল্যাণীদি বললেন, না-ই যদি যেতে পারেন একটা দিন থেকে যাবেন।আপনার কোন অসুবিধে হবে না, আমি ব্যবস্থা করে দেব।
ঈষৎ বিড়ম্বিত মুখে অর্চনা জানালো, না, যেতে হবে–।
কল্যাণীদি ভেবে বলেননি। মনের আনন্দে বলে ফেলেছেন, এই পর্যন্ত। ফার্স্ট ক্লাস শোনার পর থেকেই ভিতরে ভিতরে দারুণ আনন্দ হচ্ছে তাঁর। অত গুণের সঙ্গে বাইরের শ্রীর বরাবরই একটা শুকনো বিরোধ কল্পনা করে এসেছিলেন বোধহয়, সেটা সত্যি নয় দেখেই খুশী। যেতে হবে শুনে খেয়াল হল সত্যিই থাকা চলে না। ইন্টারভিউ দিতে এসে অজানা অচেনা জায়গায় গোটা একটা রাত কাটানোর সম্ভাবনায় যে-কোন মেয়েই অথৈ জলে পড়বে। কল্যাণীদি ঘড়ির দিকে তাকালেন। সবে তিনটে। মনে হচ্ছিল সন্ধ্যে। ঢের সময় আছে, জল একেবারে না ছাড়ুক ধরবে একটু নিশ্চয়ই।
বললেন, তা হলেও আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না, আপনাকে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা অন্তত আমি করে দিতে পারব।
মনে মনে অর্চনা নিশ্চিন্ত হল খানিকটা। নীরবে তাঁর দিকে চেয়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল।
বেয়ারার হাত দিয়ে হেডমিসট্রেসের ঘরে কাকার কাছে চিরকুট লিখে পাঠালেন কল্যাণীদি।–জনাকতক আছি। বাড়ি পৌঁছেই গাড়িটা পাঠাও আর নিখিলকে বাড়ি থাকতে বোলো।
গাড়িটা মস্ত একটা সাবেকী আমলের চকমিলানো দালানের আঙিনায় ঢুকে পড়ল যখন, অর্চনা তখনো জানে না কোথায় এসেছে। কল্যাণীদির আহ্বানে গাড়ি থেকে নেমে দ্বিধান্বিত চরণে তাঁকে অনুসরণ করল।
রামতারণবাবু নিচের ঘরেই বসেছিলেন। উঠে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।
এসো মা এসো, জলটা তোমাকে অসুবিধেয় ফেলেছে, কিন্তু আমার লাভ হল। বোসো–
কোথায় এসেছে জানতে পেরে অর্চনার কুণ্ঠা আরো বেড়েছিল। কিন্তু বৃদ্ধটিকেও ভাল লেগেছিল। দু-কথার পরেই ইস্কুলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তিনি। প্রথম কি ছিল, এখন কি হয়েছে আরো কি হতে পারে। এই স্কুলের জন্য অর্চনার দরদ থাকা চাই–দুদিন বাদে হুট করে পালালে চলবে না। এখানে বাড়ির জন্য ভাবনা নেই, বাড়ি তিনিই দেখে দেবেন, ইত্যাদি।
চাকরিটা যে কার হল সেটা জানানোর কথা আর খেয়ালই হয়নি।
ওদিকে কল্যাণীদি ভিতরে ঢুকে দেখেন, নিখিলেশ হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। মনে মনে মতলব ভেঁজেই ঘরে ঢুকেছেন। ভাল মন্দ যাই বলুন তিনি, ভাইটি উল্টো রাস্তা খোঁজে। তাই ঘরে ঢুকেই বললেন, আজ আবার তোর কলকাতা যাওয়া নেই তো?
জবাব এলে, যাওয়া দরকার। দেখি—
এই ঝড়জলে আর যায় না, শুয়ে থাক।
টিপ্পনী–এ তো আর তোমার ইস্কুলমাস্টারি নয়, এর নাম খেটে খাওয়া।
তাহলে যাচ্ছিস?
ভাইটি বোকা নয়, কিছু একটা কলে পড়তে যাচ্ছে অনুমান করে উঠে বসল–কি মতলব?
কল্যাণীদি হেসে ফেললেন, যাবি তো যা, ভাল সঙ্গী দিচ্ছি–জল দেখে বেচারী ঘাবড়ে গেছে। আমি আশা দিয়ে নিয়ে এলাম–
কার জন্য সুপারিশ তাও অনুমান করে নিতে দেরি হল না। তবু ইস্কুলের কর্মকর্তার গাম্ভীর্যে নিখিলেশ জিজ্ঞাসা করল, কাকে নিয়ে এলে?
কাকে আর, যাকে তোরা চাকরি দিলি।…ভাই উচ্চবাচ্য করছে না দেখে সংশয়ের ছায়া পড়ল।–দিয়েছিস তো, না কি?
তুমি ড্রইং মাস্টার, ড্রইং মাস্টারের মত থাকো, তোমার অত খোঁজে দরকার কি।
মরব চাঁটি, বল না?
নিখিলেশ হাসতে লাগল। কল্যাণীদি নিশ্চিন্ত হয়ে টিপ্পনী কাটলেন, আমি আগেই জানি, চারজনের মধ্যে তিনজনই পুরুষ যখন, ওই মুখ দেখে সকলেই ভুলবে।–কলকাতা না যাস তো স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আয়।
জোর করে চা-জলখাবার খাইয়ে কল্যাণীদি অর্চনাকে ছাড়লেন আরো ঘণ্টাখানেক বাদে। ছাতা মাথায় নিজেই গাড়িতে তুলে দিলেন। কিন্তু চালকের আসনে লোকটিকে দেখে অর্চনা আবারও বিব্রত। সামনের দরজা খুলে দিয়ে কল্যাণীদি বললেন, আমার ছোট ভাই নিখিলেশ দত্ত–স্কুল-কমিটির সদস্য, সে তো ইন্টারভিউতেই দেখেছেন। উঠুন–
নমস্কার জানিয়ে অর্চনা কুণ্ঠিত মুখে উঠে বসল। চাকরির চেষ্টায় এসে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ-ধরনের যোগাযোগ সঙ্কোচের কারণ।
জলের জোর কমেছে, কিন্তু থামেনি। থামার লক্ষণও নেই। গাড়ির সব ক-টা কাচ বন্ধ। কাচ বেয়ে অঝোরে জলের ধারা নেমেছে। রাস্তার দু-পাশে মেঠো জমিগুলি পুকুরের মত দেখাচ্ছে। গাছপালাগুলোও একঘেয়ে বৃষ্টির তাড়নায় বিষম ক্লান্ত। অর্চনা বাইরের দিকে চেয়ে দেখছিল।