- বইয়ের নামঃ সাত পাকে বাঁধা
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
১. মফস্বল শহরের এক পাশ
সাত পাকে বাঁধা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ, ফাল্গুন ১৩৬৬
০১.
মফস্বল শহরের এক পাশ দিয়ে গঙ্গার ধার-ঘেঁষা রাস্তার এক মাথা এসে থেমেছে মেয়ে-ইস্কুলের সামনে। উঁচু বাঁধানো রাস্তা। নিচে গঙ্গা। অসতর্ক মুহূর্তে গাড়ি ঘোড়া রাস্তা ছেড়ে যাতে নিচের দিকে না গড়ায় সেইজন্য সে-দিকটায় হাঁটু-উঁচু দেড়-হাত চওড়া বাঁধানো কার্নিস। একটু দূরে দূরে এক-একটা অতিবৃদ্ধ বট-অশ্বত্থ ডালপালা ছড়িয়ে মাঝে মাঝে গঙ্গাকে আড়াল করেছে। অন্য দিকটায় বাড়িঘর, দু-চারটে দোকানপাট, চুন-সুরকির আড়ত, আড্ডিদের মস্ত আমবাগান, কোম্পানি আমলের মুসলমান গোরখানা, পাড়ার ক্লাব-ঘর, শর্টহ্যাণ্ড টাইপ শেখার ছোট্ট প্রতিষ্ঠান, কেশ-বাহার আর বাবু-আসুন সেলুন–ইত্যাদি।
সকাল নটা না বাজতে রাস্তাটার ভোল বদলায়। ইস্কুল-মুখী মেয়েদের পায়ের ছোঁয়া পেয়ে এতক্ষণের ঝিমুনিভাব কাটিয়ে যেন সজাগ হয়ে ওঠে। সাদা লাল নীল হলদে বেগুনী ফ্রক আর শাড়ির শোভাযাত্রা শুরু হয়। কিশোরী মেয়েদের কলমুখরতায় লাল গঙ্গা আর লালচে অশ্বত্থ-বটের শান্ত উদাসীনতায় বেশ একটা ছেদ পড়ে কিছুক্ষণের জন্য।
দোতলার বারান্দায় অথবা ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে কোন কোন বাড়ির বউয়েরা খানিক দাঁড়িয়ে অলস চোখে এই প্রাণ-তারুণ্য দেখে। দত্ত স্টেশনারির প্রৌঢ় মালিক চকোলেট লজেঞ্জুস বিস্কুট ডালমুট ভরা কাচের বয়ামগুলির ওধারে এসে দাঁড়ায় চুপচাপ। বয়ামগুলি এবারে খানিকটা করে খালি হওয়ার আশা। বুড়ো মুদি মাখন শিকদার চাল ডাল তেল মুন মসলাপাতি ওজনের ফাঁকে অনেকবার অন্যমনস্ক হয়ে সামনের হাফ-জানালার ভিতর দিয়ে মেয়েদের যাওয়া দেখে। তার নাতনী আছে একটি। ছেলে নেই। নাতনী বড় হচ্ছে। আর একটু বড় হলে এই মেয়েদের মত সাজিয়ে-গুজিয়ে ইস্কুলে পাঠানো সম্ভব হবে কিনা তাই ভাবে বোধ হয়।
চুন-সুড়কির আড়তের কাছে এসে রাস্তা-ঘেঁষা সুরকির স্তূপের মধ্যে জুতোসুদ্ধ পা ঢুকিয়ে দেয় এক-একটা ফ্ৰকপরা মেয়ে। ইস্কুলে পৌঁছে পা ধোয়ার একটা কর্তব্য পালন করতে পারবে। তাদের দেখাদেখি আবার আরো ছোট এক-আধজন হয়তো পা ঢুকিয়ে দেয় চুনের ঢিপির মধ্যেই। অন্যেরা শাসন করে তক্ষুনি, পা খেয়ে যাবে মরবি–গঙ্গার জলে ধুয়ে আয় এক্ষুনি।
টাইপ-রাইটিং স্কুলের সামনে দিয়ে যেতে যেতে মুখ দিয়ে টকটক টকটক শব্দ বার করবেই কোন না কোন একদল ছোট মেয়ে। আরো-ছোটরা অনুকরণ করে তাদের। ক্লাব-ঘর পেরুনোর সময় উঁচু ক্লাসের মেয়েরা চেষ্টা করে গম্ভীর হয় একটু। নতুবা দাড়ি-গোঁপের আভাস নির্মমভাবে নির্মূল করে, মাথার চুল পাট করে আঁচড়ে, ফর্সা ধুতি আর ফর্সা স্যাণ্ডো-গেঞ্জি পরে এই সময়টায় নিস্পৃহ গাম্ভীর্যে ক্লাব-ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়ায় দু-পাঁচজন নতুন বয়সের ছেলে। কেউ কলেজের ফার্স্ট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, কেউ বা সেটুকুও ছেড়ে সম্প্রতি শুধুই শরীরচর্চা করছে। উঁচু ক্লাসের মেয়েরা মুখ গম্ভীর করে এদের প্রতীক্ষার মর্যাদা দেয়। কিন্তু একটু এগিয়ে এরাই আবার মুখে কাপড় গুঁজে হাসে সামনের কেশ-বাহার বা বাবু-আসুন সেলুনের দোর দিয়ে কাউকে ঢুকতে-বেরুতে দেখলেই। বিশেষ করে সদ্য চুল হেঁটে কাউকে বেরুতে দেখা গেলে কম করে বিশ-তিরিশ জোড়া চপল চোখ সেই মাথাটা চড়াও করবেই।
দলে দলে মেয়েরা যায় বই বুকে করে, বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে অথবা বই ভরা ছোট ছোট রঙ-করা টিনের বাক্স দোলাতে দোলাতে। রাস্তা জুড়ে চলে তারা। এরই মধ্যে সাইকেল-রিকশর ভেঁপু কানে এলে দু-পাশে সরে আসে। তার পর ঘাড় ফিরিয়ে দেখে কে যায়।
মাস-ভাড়া সাইকেল-রিকশয় ঠাসাঠাসি হয়ে চলেছে মীরাদি আর প্রভাদি। মীরা সান্যাল, প্রভা নন্দী। ওই দুজনের পক্ষে ওটুকু বসার জায়গা যথেষ্ট নয়। বড় মেয়েরা টিপ্পনী কাটে আর হাসে! ছোট মেয়েরা তাদের হাসির কারণ বুঝতে চেষ্টা করে। একটু বাদে আবার শোনা যায় সাইকেল-রিকশর ভেঁপু।
কে আসে?
প্রতিভাদি আর শোভাদি। প্রতিভা গাঙ্গুলী, শোভা ধর। তাদের দুজনের মাঝখানে আবার একটা ছোট মেয়েকে অন্ততঃ বেশ বসিয়ে নিয়ে যাওয়া চলে। সাইকেল-রিকশ অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে দু-পাশ থেকে রাস্তার মাঝখানে জড়ো হয়ে চলতে চলতে বড় মেয়েরা এক-একদিন সেই পুরনো গবেষণায় মেতে ওঠে –উল্টে পাল্টে ঠিক করলেই তো পারে সাইকেল-রিকশ–মীরাদির সঙ্গে প্রতিভাদি, আর প্রভাদির সঙ্গে শোভাদি। নয়তো, মীরাদি আর শোভাদি আর প্রভাদি আর প্রতিভাদি। চিরাচরিত সিদ্ধান্তেই এসে থামতে হয় আবার। অর্থাৎ যার সঙ্গে যার ভাব।
আবার কে আসে?
ও বাবা। মালতীদি আর স্মৃতিদি! মালতী রায়, স্মৃতি কর! হেডমিসট্রেস আর সহকারী হেডমিসট্রেস। সর সর!
রাস্তার দু-পাশ ঘেঁষে চলে মেয়েরা। একটানা ভেঁপু বাজিয়ে সাইকেল রিকশ তরতরিয়ে চলে যায়। সাইকেল-রিকশর চালকও আরোহিণীদ্বয়ের মর্যাদা জানে যেন।
এদিক থেকেই আসেন মেয়ে-স্কুলের বেশির ভাগ টিচার। শেয়ারের মাস ভাড়া সাইকেল-রিকশ, সকালে নিয়ে আসে বিকেলে পৌঁছে দেয়।