গেল বারে কালীপুজো উপলক্ষে রাধা কোথাও গাইতে বেরোয়নি, এবারে এসেছে। সুচারু দেবী স্বামীকে আগে থাকতেই তাড়া দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এমনই চাকরি পুলিশের, বেরুবার ঠিক আগে দুটো ছেলেকে নকশাল সন্দেহে ধরে আনা হয়েছে, তারা নাকি কোথাকার এক খুনের ব্যাপারে জড়িত।
ঝামেলা তখনকার মতো চাপা দিয়ে এসে পৌঁছুলেন যখন, রাধার সবে তখন তৃতীয় গান শেষ হয়েছে। শ্রোতাদের এবারের তাগিদ, ক্ষ্যাপা বাবার গান, বামা ক্ষ্যাপার সেই গান থোক।
দেরির জন্য সুচারু দেবী স্বামীর ওপর বিরক্ত, কিন্তু তক্তাপোষের ওপর সাদা চাদর বিছানো মঞ্চে রাধাকে দেখে তাঁর দু’চোখ জুড়িয়ে গেল। পরনে চওড়া হালকা নীল-পাড় আনকোরা শাড়ি, গায়ে সেই রঙের ব্লাউস, পিঠের ওপর খোলা চুল ছড়ানো। মঞ্চে জোরালো আলো। সেই আলোয় চব্বিশের উপছানো কালো রূপের যৌবন শুধুই যেন শান্ত ভাবের শাসনে বাঁধা। হাটু মুড়ে পিছ-পা করে বসা, মেরুদণ্ড সোজা। দু’চোখ বোজা, অল্প অল্প দুলছে।
অস্ফুট স্বরে সুচারু দেবী বললেন, আগের থেকেও কত সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে–আ-হা!
শেষের আ-হাটুকু অকাল বৈধব্যের কারণে। গান শুরু হতে শ্রোতারা একেবারে চুপ।
তুই যেমন মা ধনীর বেটী বাবা তেমন ধনীর বেটা।
বুড়োবৃষ সিদ্ধির ঝোলা এই তোমাদের পুঁজিপাটা।
ধন দিবি তোর মাথা মুণ্ড, বাবার তরে বিষের ভাণ্ড
তোমার সম্বল নরমুণ্ড, হাতে একটা গলায় কটা।
বাস বিনা শ্মশানবাসিনী বস্ত্ৰবিনা উলঙ্গিনী
অন্ন বিনা ত্রিশূলপাণি, পায়ে পড়ে দেখায় ঘটা।
ঘুরে ফিরে দুবার করে গাইল। একটু স্থির হয়ে বসে থেকে আবার অনুরোধ আসার আগেই উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে সকলের উদ্দেশ্যে নমস্কার করল।
বেশি না হলেও রাধার গান অংশুমান আগেও শুনেছেন। খারাপ অবশ্যই লাগেনি। কিন্তু কোনরকম ভাব বা আবেগের যোগ ছিল না। অথচ আশ্চর্য, আজ চোখের কোণ দুটো কি রকম শিরশির করে উঠল, বুকের তলার অনুভূতিটুকুও অন্যরকম। গানের দরুণ নয়, নিজের মনেই একটু পরিবর্তনের আভাস পাচ্ছেন।
আগেই বলা ছিল, উঠে দুজনে সামনের ক্লাবঘরে গিয়ে দাঁড়ালেন। মিনিট দুই বাদে একজন ভলান্টিয়ার রাধাকে তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেল।
দেখেই রাধা খুশি।–ও মা, বড়বাবু যে! দিদি কেমন আছ?
সুচারু দেবী তার হাত ধরলেন, আগে তোর কথা বল, আমাদের তো ত্যাগই করেছিস।
অপ্রতিভ মুখে নিজের দোষ স্বীকারই করল যেন। ডেকে পাঠিয়েছিলে তবু যেতে পারিনি–কিন্তু কি করি গো দিদি, মা যেন গলায় গামছা বেন্ধে টানি রেখেছে।
অংশুমান বললেন, তোর দিদির ধারণা আমার ওপর রাগ করেই তুই আর আসিস না
রাধার দু’চোখ বড় বড়, আমি রাগ করতি যাব কেন গোয় তার পরেই মনে পড়তে হেসে উঠল। তাই তো! তোমার ইখেন থেকে নড়ার কি হল গো বড়বাবু-ক’বছর হল?
অংশুমানের ভালো লাগছে, হালকা বোধ করছেন। জবাব দিলেন, অনেক বছর, নড়ার কি হল দেখতেই পাচ্ছি।
রাধা হেসে সুচারু দেবীকে বলল, রাগ করব কি, আমার মনেই ছেল না। বড়বাবুর দিকে ফিরল, দুঃখ করছ কেন, ভালোই তো আছ
এই প্রথম একটু দুর্বলতা ধরা পড়ল অংশুমানের।– ভালো করে দ্যাখ, দেখি, এ-রকম ভালোই এখন থেকে যাবে?
রাধার ডাগর দু’চোখ আস্তে আস্তে তার মুখের ওপর স্থির হল। অপলক কয়েক পলক। তারপর হালছাড়া গোছের করে জবাব দিল, হলনি, মা কিছু বলে দেল না, আমি কি কিছু জানি যে নিজে বাহাদুরি করে বলব!
এই জবাবই আজ কেন যেন সব থেকে ভালো লাগল অংশুমানের।
.
আরো একটা বছর গড়াতে চলল। রাধার পঁচিশের যৌবনে আবার একজনের পঞ্চার দিনে দিনে যেন অমোঘ হয়ে উঠছে। গোড়ায় গোড়ায় রেগে গেছে, সমস্ত সত্তা দিয়ে প্রতিরোধ করতে চেয়েছে। এখনো নিজের সঙ্গে যুঝছে, কপালী বাবার সঙ্গে যুঝছে, আর ওই একজনের সঙ্গেও যুঝছে। কিন্তু যোঝার জোর কমে আসছে তা-ও নিজেই অনুভব করছে।
ওই একজন মনোহর পাইক।
ক’বছর আগে কপালী বাবার কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার ব্যাপারে একবার রাধার কাছেও এসেছিল মনোহর পাইক। কপালী বাবাই বলেছিলেন, আমি না-হয় ক্ষমা করলাম, কিন্তু রাধা ভুল বুঝছে, একবার তাকে বলে যা
আপোসের মুখই বটে তখন, কিন্তু দু’চোখে তখনো রাধা থেকে থেকে লোভ চিকিয়ে উঠতে দেখেছে। তবু সত্যিই রাগ করেনি, কারণ এত বছরের লোভ ছাড়ব বললেই একদিনে ছাড়া যায় না। কিন্তু মুখে রাগ দেখিয়েছে। বলেছে বিবাগী হবার দশা তোমার নয়, পয়সার জোর হয়েছে, খুঁজলে আমার থেকে ঢের ভালো আর ঢের সুন্দর মেয়ে পাবে, ফের যখন আসবে একেবারে বউ নিয়ে এসো।
মনোহর বলেছে, তুই ভালো থাক, আমার ভাবনা আমিই ভাবতে পারব।
কিছুদিন বাদে মনোহরের মা মারা গেল শুনে কর্তব্যের দায়ে এক বা তার ওখানে গেছল শোক যে কত মুখ দেখেই বোঝা গেছে। যতক্ষণ ছিল, লোভের চাউনি সর্বাঙ্গ ছেকে ধরে ছিল। রাধা দায় সেরে হাঁপ ফেলে ঘরে ফিরল পরের দু’বছরে অনেক গানের আসবেই রাধা তাকে দেখেছে। ভক্তির গানে কিছুমাত্র আগ্রহ নেই বাধা খুব ভালো করেই জানে! ছেলেবেলায় অনেক বার বলেছে, ও সব গান ছেড়ে সিনেমার গান শেখ না। কেবল দেখার টানেই আসে জানা কথা। কিন্তু বাক্যালাপ এর মধ্যে আর হয়নি।
হারাণ মণ্ডল মারা যাবার পর দেখা করতে আসেনি। বুদ্ধি আছে বলেই আসেনি। এলে রাখা হয়তো তাড়িয়েই দিত। বেশ ভালো করেই জানে ওই মৃত্যুতে খুশি কেবল এই একজনই হয়েছে। দু’দিন আগে হোক পরে হোক উৎপাত শুরু হবে জেনেই মনটাকে কঠিন করে তুলছিল। প্রথম মাস দুই রাধা কপালী বাবা অর্থাৎ জংলি কালীর কাছে গিয়ে বসে থাকত। খেয়াল খুশি মতো নাম করত। বিকেলে বিকেলে যাবার সময় রাধা পিছনের পুকুর পার ধরে জংলা পথে যায়, কিন্তু রাতে ফেরার সময় সদর দিয়েই ফিরতে হয়। এক এক রাতে সেখান থেকে বেরিয়ে দেখে সাইকেল নিয়ে ওই মূর্তি দাঁড়িয়ে। রাধা রাগে রি-রি করতে করতে বাড়ি ফেরে, কিন্তু সজ নিয়ে মনোহর একটি কথাও বলে না। রাধাকে ডেরা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সাইকেলে চেপে চলে যায়।