ঠাণ্ডা মুখে ঘোষ সাহেব জিগ্যেস করলেন, এখন তাহলে বায়োপসি ছাড়া আর কিছু করার নেই?
আবার মাথা নাড়লেন।–দেখুন আপনার কিছু টাকার জোর থাকলে আমি এখনই কাটা-ছেঁড়ার বা ঘাঁটাঘাটির মধ্যে যেতে রাজি নই ..বম্বের টাটা জশলোক হসপিটাল থেকে বিনা বায়োপসিতে গ্রোথ টেস্ট করে আনতে পারেন, ওখানে ছাড়া এ-দেশে আর কোথাও ওই টেস্ট করার ব্যবস্থা নেই।
দু’জনেই উৎসুক আমরা। জিগ্যেস করলাম, কি টেস্ট ওটা?
–নাম বললে বুঝতে পারবেন না, বিরাট ল্যাটিন নাম–ধরুন অনেকটা ই. সি. জি’র মতো, হাইলি কমপিউটারাইজড, ইলেক্ট্রোগ্রাফিক মেথডে এটা করা হয়, এর রিডিং থেকে বোঝা যায় গ্রোথ বিনাইন কি ম্যালিগন্যান্ট অথবা মাঝামাঝি কিছু।…আপনাদের বলেই দিই, রিডিং যদি একশ চল্লিশ ইউনিটের মধ্যে পাওয়া যায় তাহলে ওটা বিনাইন–ভাবনার কিছু নেই, একশ পঁয়তাল্লিশ পর্যন্তও ইগনোর করা চলে, আবার একশ ষাট হলে ধরে নিতে হবে ডেফিনিটলি ম্যালিগন্যান্ট আর একশ পঁয়তাল্লিশ থেকে একশ উনষাট হল ট্র্যান জিটারি স্টেজ–যত বাড়বে ততো ম্যালিগন্যানসির সম্ভাবনার দিকে যাচ্ছে ধরে নিয়ে চিকিৎসা করতে হবে।
ঘোষ সাহেব ঠাণ্ডা মুখেই জিগ্যেস করলেন, এটা সিওর টেস্ট?
–বায়োপসির থেকে বেশি ছাড়া কম সিওর নয়।
–বম্বে গিয়ে এই টেস্টের রেজাল্ট পেতে কিরকম সময় লাগবে?
হসপিটালের দিক থেকে কোনো অসুবিধে না থাকলে আপনি দু’দিনের মধ্যেই রেজাল্ট নিয়ে চলে আসতে পারেন।…এখান থেকে অ্যাডভাইস আর টেস্ট রিপোর্টগুলো নিয়ে যেতে হবে, সেই সঙ্গে ওখানকার একজনকে একটা পারসোনাল চিঠিও দিতে পারি।
ঘোষ সাহেবকে একটু চিন্তায় মনে হল। জিগ্যেস করলেন, ধরুন আমি যদি দিন দশেক পরে যাই…তাহলে কি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা।
–কিছু না কিছু না, এক বছরের ওপর এভাবে আছেন, দশ পনেরো দিনে আর কি ক্ষতি হবে।…তবে এ-সব ব্যাপারে খুব একটা দেরি না করাই ভালো।
ঘোষ সাহেব জানালেন তিনি ঠিক দশ দিন পরেই যাবেন, সেই অনুযায়ী উনি যেন অ্যাডভাইস আর চিঠিটা লিখে রাখেন।
চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছি। আমার ভিতরটা উদ্বেগে আচ্ছন্ন। একটু বাদে ঘোষ সাহেব বেশ হালকা গলায় বললেন, গোপনতার পাট শেষ তাহলে… কিন্তু আমি দমে যাচ্ছি কেবল মেয়েটার কথা ভেবে, একেবারে বাচ্চা বয়েস থেকে ও আমার মা হয়ে বসে আছে, ভয়ে দুশ্চিন্তায় আধ মরা হয়ে যাবে।
প্রায় আধা-আধি পথ পেরিয়ে এসে আমি মুখ খুললাম। বললাম, যদি চার আনা মিথ্যে আর বারো-চৌদ্দ আনা মিথ্যের মধ্যে কোনো তফাৎ না ধরেন আমার মনে হয় এখনো ওদের কিছু না বলাই ভালো, কাউকে কিছু না জানিয়ে আপনাকে বম্বে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমি নিতে পারি–
উৎসুক মুখে আধা-আধি ঘুরে বসলেন প্রায়।–কি করে?
কি করে বলতে উনি নির্বাক খানিক। কাউকে জানতে বুঝতে না দেবার এমন সহজ রাস্তাও থাকতে পারে সেটা তাঁর অবশ্য কল্পনা করার কথাও নয়। হাত তুলে আমার কাঁধে দু’বার মৃদু চাপ দিলেন। কৃতজ্ঞতা জানাবার আর কোনো ভাষা নেই। বললাম, কোন সময়ে ছেলেমেয়ের সামনে আপনি কথাটা তুলবেন সেটা পরে ঠিক করা যাবে, এখন বলুন তো আপনি মাঝখানে দশ-দশটা দিন সময় নিলেন কেন?
–আপনাকে বলা হয়নি, কাল পরশুর মধ্যেই বলতাম, আর ঠিক ছ’দিন বাদে কালীপুজো, আট বছর ধরে এই পুজোটি আমার বাড়িতে হয়ে আসছে..আমি করছি বললে ঠিক হবে না, আমাকে দিয়ে করানো হচ্ছে।
আমি বেশ অবাক।–রাধা করাচ্ছেন?
–আর কে… তবে আলাদা কোনো মূর্তি এনে পুজো নয়, আমার ঘরে কালীর যে বড় ফোটোখানা দেখেন, তাকেই বেদিতে সিয়ে পুজো–এও ওই মেয়েরই বিধান, বলে সবই এক, আলাদা মূর্তি গড়িয়ে কি হবে? আর ওমুক সময় তমুক সময় বা মাঝ রাত্তিরে পুজো–এ সবও নেই, আমাদের পুজো রাত এগারোটার মধ্যেই শেষ–ও অবশ্য সমস্ত রাত ধরেই পুজো করে।
…আট বছর ধরে পুজো চলছে মানে অংশুমান ঘোষ তখন ও. সি’র থেকে বড় পোস্টে। এই মানুষকে কালীপুজোয় নামিয়েছে। মেয়েটার ক্ষমতা আছে বলতে হবে। আর এ-পুজো এখন ভদ্রলোকের কাছে এমনই ব্যাপার যে গলার রোগের সঙ্কটও তার পরের ভাবনা। আমার স্নায়ু জুড়ে সেই পুরনো কৌতূহল, এই মেয়ের কি ঘটনা আর বিশ্বাসের নজির দেখে ভদ্রলোকের এ-রকম পরিবর্তন।
জিগ্যেস করলাম, বেশ ঘটা করে পুজো নাকি?
–আগে তাই হত, রাধার আবার এ পুজোয় ঘটা পছন্দ কিন্তু মুশকিল কি জানেন মশাই, লোকে ভাবে ব্যাটা পুলিশের চাকরিতে কত পাপ করেছে ঠিক নেই, যার ফলে এখন পুজো করে দোষ কাটানোর চেষ্টা–তবু লোকজন হয় কিছু, রাধার সঙ্গে দু’চারজন আসে, মেয়ে আর ছেলের শ্বশুর বাড়ির সব আসেন, ভক্তিশ্রদ্ধা আছে এমন আরো দু’পাঁচজনকে বলি, এবারে আপনি আছেন, আপনার বাড়ির সক্কলকেও আনতেই হবে–আমি নিজে গিয়ে বলে আসব। আমার মনে হয় আপনার ভালো লাগবে।
তাঁর অগোচরে গাড়ির গতি অনেকটাই কমিয়ে দিলাম। বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি, মনে যা আসছে ভদ্রলোকের মানসিক অশান্তির মধ্যে সেটা বলব কি বলব না সেই দ্বিধা। আড়চোখে এক বার দেখে নিলাম। মনে হল কালীপুজোর নামে আপাতত রোগের চিন্তা ভুলে গেছেন।
–ইয়ে, পাড়ার আর কাউকে বলবেন না?
ভদ্রলোক কত চতুর সেটা তাঁর পরের কথা থেকেই বোঝা গেল। আমার প্রশ্ন শুনে ঘুরে একটু দেখে নিলেন। তারপর হেসে বললেন, আপনার কাছে আমার ঋণের পাহাড় জমছে, আমাকে আর একটা ভুলের হাত থেকে বাঁচালেন। এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসার পর থেকে আপনার ওপর আমি যেভাবে দখল নিয়ে চলেছি তাতে প্রতিবেশীদের কাছে আপনাকে অপ্রস্তুত হতে হয় কিনা এ-চিন্তা আমার মাথায় আসা উচিত ছিল। নিশ্চয় করব। ভদ্রলোকদের নিজে গিয়ে কর্তাদের বলে আসব, আর বাড়ির সকলকেও নেমন্তন্ন করতে মেয়ে বা বউমাকে পাঠাবো–