অমল দাস বলল, তুমি না অজ্ঞান হয়ে ছিলে?
জবাব না দিয়ে মেয়েটা করুণ দুটো চোখ মেলে তাকাল শুধু।
বৃন্দাবন তাড়াতাড়ি বাধা দিল, অজ্ঞান হলেও জ্ঞান ফিরেছে দেখছিস না, এস এস, ঘরে এস। হাত ধরে ঘরের দিকে টানল তাকে। কিন্তু মেয়েটা সত্যিই জখম হয়েছে, হেঁটে আর আসতে পারছে না। বৃন্দাদা টেনেটুনে তাকে ধরে এনে বসাল। তারপর সর্বাঙ্গের আঘাত লক্ষ্য করে তক্ষুনি ডিসপেনসারির উদ্দেশ্যে ছুটল।
দুহাত কোমরে তুলে অমল দাস গম্ভীর মুখে তাকে দেখল একটু।
তোমার নাম কি?
অতসী।
ওভাবে ওখানে পড়ে ছিলে কেন?
ওরা চলন্ত গাড়ি থেকে আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।
অমল দাস আঁতকে উঠল, কারা ফেলে দিয়েছিল?
সংক্ষেপে যা শুনল তাতেই চক্ষুস্থির তার। কতগুলো বদমাস ছেলে অতসীকে জোর করে রাস্তা থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল–পাড়ার চেনা গুণ্ডা ছেলে সব। সৎ মায়ের সঙ্গে তাদের খুব ভাব ছিল, মনে হয় সৎ মাকে টাকাও দিয়েছে ওরা। অনেক দূরে আসার পরে একটা পুলিশের গাড়ি হঠাৎ পিছু ধাওয়া করতে সেই ছুটন্ত গাড়ি থেকে ওকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ওরা পালিয়ে যায়। তারপর আর কিছু জানে না।
কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা কাটিয়ে অমল দাস বলল, রিকশাতে জ্ঞান ছিল তোমার তবু অজ্ঞানের ভান করে ছিলে কেন?
তুমি তাহলে বাড়ি দিয়ে আসতে চাইতে আমাকে।
বাড়ি যাবে না তো কোথায় থাকবে?
জানি না। বাড়ি গেলে বাবা আর সৎমা এবারে মেরেই ফেলবে আমাকে।
বাবা কি করে?
কলে কাজ করে…ভয়ানক মদ খায়। আর মায়ের কথা শুনে আমাকে মারে। আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসতে চাইলে আমি আত্মহত্যা করব।
মেয়েটাকে খুঁটিয়ে দেখল অমল দাস। রোগা একটু, নইলে মন্দ না। খাইয়ে দাইয়ে পুষ্ট করে তুলতে পারলে বৃন্দাদার লাভ মন্দ হবে না। মরুকগে, বৃন্দাদাই দায় সামলাক এখন, তার ভেবে কাজ কি?
বৃন্দাবন পাল একজন চেনা কম্পাউণ্ডার নিয়ে এল। সে ওষুধপত্র দিয়ে চলে গেল। তারপর অমলের মুখে সব শুনে বৃন্দাবনও খুব খুঁটিয়ে দেখে নিন মেয়েটাকে। তার চাপা আনন্দ গোপন থাকল না। অতসীর আদর যত্নের ব্যবস্থায় কোন রকম। কার্পণ্য করল না। আশ্বাসও দিল, তার সুব্যবস্থা সে-ই করে দেবে।
আর ভাগ্য এমনই, পরদিনই একগাদা ভাল ভাল একস্ট্রা যোগাড় করতে হল নতুন ছবির কাজের জন্য। তাদের মধ্য থেকে কর্তার চোখে লাগা দু দুটো মেয়ে একেবারে জলের মত টোপ গিলল। কর্তা তাদের এক মাসের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন নিজের বাগানবাড়িতে। আর সেই সঙ্গে বৃন্দাবনকে ঝোঁকের মাথায় দুশ টাকা বখশিস করে ফেললেন।
অতসীকে খুব পয়মন্ত মেয়ে ধরে নিল বৃন্দাবন।
এক মাসের মধ্যেই খেয়ে দেয়ে আর শান্তিতে থেকে শ্রী ফিরে গেল অতসীর। বৃন্দাবন দুচোখ ভরে দেখে তাকে আর আরো ভাল দেখার আশায় দিন গোনে। তাছাড়া মেয়েটার মস্ত গুণ, সুন্দর রাঁধতে পারে–খেতে বসে মনে হয় অমৃত খাচ্ছে। অমল আর বৃন্দাবন মাঝারি ঘরটায় থাকে, আর খুপরিটাতে অতসী থাকে।
এক মাসের মধ্যেই অমলের কাছে মনের কথা ব্যক্ত করে ফেলল বৃন্দাবন। অতসীকে বিয়ে করবে। এদিকের খুপরি থেকে অতসী নিজের কানেই শুনল প্রস্তাবটা। অমলের জবাবও। এরা কেউ রেখে ঢেকে কথা বলে না। অমল জবাব দিল, কেন ঝামেলায় পড়বে আবার, তার থেকে আর একটু তরতাজা করে নিয়ে তোমার কর্তার কাছে পাঠিয়ে দাও, এদিকে ফোটো ভাল উঠলে ছবিতে একস্ট্রা করেও রোজগার করতে পারবে–মোট কথা তোমারও পয়সা হবে ওরও হিল্লে হবে।
বৃন্দাবন পাল বিরক্ত। বলল, তুই বড় নৃশংস হয়ে গেছিস। অতসী আমার লক্ষ্মী, ওকে আমি কোথাও পাঠাতে পারব না– দিন-টিন দেখে সামনের মাসেই বিয়েটা করে ফেলব ভাবছি।
এদিকের খুপরি থেকে অতসী তার উদ্দেশে বড়-সড় ভেঙচি কাটল একটা। কিন্তু সেই সঙ্গে কৌতূহলও খুব। অমলদা ওকে কার কাছে পাঠিয়ে পয়সা রোজগারের কথা বলছে? ফোটো ভাল হলেই বা কি করবে?
বৃন্দাবন বেরিয়ে যেতে তার ওপর চড়াও হল। বাড়িতে মাঝে মাঝে দুই একটা মেয়ে এক একটা আবেদন নিয়ে আসে দেখে, কি চায় ঠিক বুঝে ওঠে না। কিন্তু গোড়া থেকেই অমল দাস অতসীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি বড় একটা। কেবল খেতে বসলে খুশি। বলে, তুই রাঁধিস বেশ, না হলে বৃন্দাদার কথায় তোকে কখনো বাড়িতে রাখতুম না–মেয়েছেলের ঝামেলা ভাল লাগে না।
অতসীও ফোঁস করে ওঠে, ঝামেলাটা কি?
ঝামেলা না তো কি, যে দেখে সে-ই জিজ্ঞেস করে কে?
তা জবাব দিলেই পারো?
কি জবাব দেব, বদ ছেলেদের ফুর্তি ফসকে এখানে এসে গেছে?
তা কেন, বলবে ভবিষ্যতে আপনার জন কেউ হবে।
অমল ওকে মারার জন্য তেড়ে আসে। অতসী ছুটে পালায়। যখন তখন এইরকম খটাখটি লেগেই আছে। যা করতে বলে একবারে শোনে না। তর্ক করে, অবাধ্য হয়। শাসন করতে গেলে বৃন্দাদার কাছে পালায়।
সেদিন অতসী সরাসরি এসে কৈফিয়ত তলব করল, কি ব্যাপার তোমাদের বল তো? আমাকে কার কাছে পাঠাবার কথা বলছিলে? আর ফোটোর কথাই বা কি বলছিলে?
অমল খেঁকিয়ে উঠল, তা দিয়ে তোর দরকার কি?
দেখ, বড় ভাইয়ের বউ হতে যাচ্ছি, দস্তুরমত মান্যিগন্যি করবে আমাকে–আর খবদ্দার তুই-তুকারি করবে না। তা আমাকে নিয়ে যখন কথা হচ্ছিল তখন আমি না শুনলে কে শুনবে?
যা যা এখান থেকে–বৃন্দাদার ভীমরতি ধরেছে