- বইয়ের নামঃ দুজনার ঘর
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আকাঙ্ক্ষা
এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে দেখা গৌরকিশোর অধিকারীর। বন্ধ ট্রামের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন আর গৌরকিশোর মস্ত ঝকঝকে গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছিলেন। ট্রাফিকের লাল আলো জ্বলতে গাড়িটা একটা বাসের পিছনে দাঁড়িয়ে গেছল। বন্ধুই তাঁকে প্রথম দেখেছেন, তারপর না চেনার মত করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু গৌরকিশোর তাকে দেখামাত্র উৎফুল্ল। ড্রাইভার তাঁর ইঙ্গিতে গাড়ি পিছিয়ে নিয়ে বাঁয়ের ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড় করিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে তিনি বন্ধুকে ধরেছেন। তাকে জাপটে ধরে টেনে এনে গাড়িতে তুলেছেন। তারপর সানন্দে বলে উঠেছেন, ভাগ্যিস দেখেছিলাম, তুই তো অন্যদিকে মুখ ফিরিয়েছিলি!
বন্ধু জবাব দিয়েছেন, তোমাকে আর তোমার গাড়ি দেখে মুখ ফিরিয়েছিলাম –
কেন, কেন? গৌরকিশোরবাবু ঈষৎ- অপ্রস্তুত।
–সংকোচে আর হিংসেয়।
গৌরকিশোরবাবু হা-হা শব্দে হেসে উঠেছেন। তকমা আর টুপী পরা ড্রাইভার সচকিত হয়ে সামনের আয়না দিয়ে তাঁর মুখ দেখতে চেষ্টা করেছে। গাড়ি সামনের রাস্তা ধরে চলেছে।
বন্ধুর জবাব শুনে বেশ মজার খোরাক পেয়েছেন গৌরকিশোরবাবু। জিজ্ঞাসা করলেন, সংকোচ কিসের আর হিংসেই বা কেন?
ড্রাইভারকে বাঙালী মনে হয়নি বন্ধুর। তাই গলার স্বর স্বাভাবিক রেখেই জবাব। দিলেন, সংকোচ তোমার অবস্থান্তর দেখে আর হিংসে তোমার স্ত্রী-ভাগ্য দেখে।
গৌরকিশোরবাবুর মুখে হাসি ধরে না।–এই দুটো ব্যাপারই যে অবশ্যম্ভাবী সে তো তুই হাত দেখে আর কুষ্টি দেখে অনেক আগেই বলে দিয়েছিলি!
-তা বলেছিলাম হয়ত, কিন্তু গণনা করা আর স্বচক্ষে তার সফল রূপ দেখার মধ্যে কিছু তফাৎ আছে। আর অভাজনদের কিছু কিছু উক্তি কানে এসেছে, যার ফলে তোমাকে দেখামাত্র ওই তফাৎটা চোখ ধাঁধিয়েছে।
হাসিমুখে গৌরকিশোরবাবু বন্ধুর গন্তব্যস্থল জেনে নিলেন। বাড়ি যাচ্ছেন শুনে খুশিমনে তাকে পৌঁছে দিতে চললেন। আপাতত তিন-কোয়ার্টার ফ্রী তিনি, অতএব বন্ধুর বাড়িতে দশ বিশ মিনিট বসে একটু আড্ডা দেবারও সময় হবে। তারপর সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করলেন, অভাজনদের আবার কি উক্তি কানে এলো তোমার?
সুবিনয় দাশগুপ্ত বাড়িতে তোমার সঙ্গে দেখা করতে গেছল, তুমি ব্যস্ত ছিলে বলে তাকে বসতেও বলোনি, এগিয়ে এসে দুই এক কথা বলে সিঁড়ি থেকেই তাকে বিদায় করেছ।
-ও হ্যাঁ, সেদিন স্ত্রীর কয়েকজন বন্ধু আর বান্ধবী এসেছিলেন, কি একটা প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা চলছিল।
–আর মাস ছয় আগে এক বৃষ্টির দিনে তোমার গাড়ি ট্রামের পাশ কাটাতে গিয়ে ফুটপাতে অমল ঘোষের জামাকাপড় রাস্তার জলে ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেছল। তুমি তাকে দেখেছিলে, তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলে।
গৌরকিশোরবাবু একটুও চিন্তা না করেই মাথা নাড়লেন।জলের ধারে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়ায় কেউ? বেচারার কোমর পর্যন্ত ভিজে সারা!…গাড়িতে সেদিন স্ত্রী শ্বশুর শাশুড়ী শালা সবাই ছিলেন, সেদিনও এক বড় ইন্ডাসট্রিয়াল ম্যাগনেটের বাড়িতে পার্টি ছিল। তারপর, আর কিছু?
বন্ধু মাথা নাড়লেন, আর কিছু না।
গৌরকিশোর অধিকারী হৃষ্টমুখে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, অবশ্যম্ভাবী অবস্থান্তর আর স্ত্রী-ভাগ্যের পরে আমার যে এরকম পরিবর্তন হবে হাত আর কুষ্ঠি দেখে সেটা বুঝি আঁচ করতে পারিসনি?
বন্ধু মাথা নাড়লেন, পারেননি।
গৌরকিশোরবাবু ড্রাইভারকে দ্বিতীয় দফা সচকিত করে হা-হা শব্দে হেসে উঠলেন।
বন্ধুর বাড়িতে এসে চা হল, গল্পগুজব হল খানিক। কথা বেশি গৌরকিশোরই বললেন। সামাজিকতা লৌকিকতার ঝামেলায় সময়ের অভাব কত কম, সরস হাসি মুখে সেই গল্প করলেন। শালার সঙ্গে নতুন স্টাল অ্যাও নেট অ্যায়ারিং-এর ব্যবসা কি রকম চলছে গম্ভীরমুখে সেই ফিরিস্তি দিলেন।
বন্ধুর শ্রোতার ভূমিকা।
শেষে হঠাৎ এক সময় হাত বাড়িয়ে দিলেন গৌরকিশোর অধিকারী, বললেন, আমার কুষ্ঠি তো তোর মুখস্থই ছিল–হাতের সঙ্গে মিলিয়ে আর একবার দ্যাখ দেখি-কলেজের মাস্টারি ছেড়ে এই ব্যবসায় নামলে তুই সত্যিই লাল হয়ে যেতিস!
হাতের ওপর হাত-দেখা কঁচ ফেলে বন্ধু গম্ভীর মুখে খানিক রেখা পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি জানতে চাও, বলো।
-আমি বলব কি, তুই বল!
-তোমার সদ্য বর্তমানের আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ আমার জানা নেই, বলো কি জানতে চাও?
মুখের দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসছিলেন গৌরকিশোর। হাসিটা কমে আসতে লাগল। চোখে চোখ রেখে চেয়েই রইলেন খানিক। তারপর সাদাসিধে স্পষ্ট গলাতেই জিজ্ঞাসা। করলেন, আমার স্ত্রীর চোখে কোনদিন জল দেখতে পাব?
এবার বন্ধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন তার দিকে।
গৌরকিশোরের মুখে হাসির ভাজ পড়তে লাগল আবার।–কি বলে তোমার গণনা, পাব?
বন্ধু মাথা নেড়ে জবাব দিলেন, আমার জ্যোতিষী বিদ্যায় এটা বলা সম্ভব নয়।
গৌরকিশোর জোরেই হেসে উঠলেন এবারে। পরমুহূর্তে ঘড়ি দেখেই আঁতকে উঠলেন প্রায়, দেখেছ কাণ্ড! চলি ভাই
হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ির দিকে চললেন তিনি।
গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে তাড়া দিলেন, তুরন্ত চলো–
গাড়ি ছুটল। অসহিষ্ণু অস্বস্তি নিয়ে হাত-ঘড়িটা দেখলেন আবার। স্ত্রীকে যেসময় দিয়েছিলেন তার থেকে সাত আট মিনিট দেরি হবেই পৌঁছুতে। গৌরকিশোরবাবুর চাপা অস্বস্তি সাত আট বছর দেরিতে পৌঁছুনোর মত। সময়ের হিসেব না থাকাটা কালচারের একটা বড় খুঁত।