- বইয়ের নামঃ ফেরারী অতীত
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
ক্ষুধা
ট্রেনে সাধারণত থার্ড ক্লাসের খদ্দের আমি। স্লপার কোচে সাড়ে চার টাকার বাড়তি মাশুল গুনে রাতে ঘুমোবার জন্যে একখানা বেঞ্চ পেলেই খুশি। ফলে অভ্যেসখানা এমন হয়েছে যে, বরাতজোরে সদ্য বর্তমানে ফার্স্ট ক্লাস রিজার্ভ কোচের চারজনের বিচ্ছিন্ন কম্পার্টমেন্টে এত আরামের জায়গা পেয়েও ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ বাদেই ভেতরটা ওই থার্ড ক্লাসের জন্যেই আনচান করে উঠেছিল। অথচ একটু আগে এই অভিজাত খুপরিতে পদার্পণ করে এবং আসন নিয়ে ভেতরটা প্রসন্ন হয়ে উঠেছিল। পরিষ্কার চকচকে কামরা, দুদিকে দুটো পুরু গদিআঁটা বার্থ, আর ওপরে তেমনি গদিআঁটা আরো দুটো বার্থ। বেশ চওড়া। শুলে পিঠের সিকিভাগ বেরিয়ে থাকার সম্ভাবনা নেই। মাথার ওপর চারজনের জন্যে চারটে পাখা, দুটো বড় সাদা লাইট, একটা সবুজ লাইট, শিয়রের দিকের ওপরে নাচে চার কোণে চারটে শেড-দেওয়া ছোট পড়ার লাইট-স্বাচ্ছন্দ্যের আরো কিছু আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা। সামনের দরজাটা টেনে দিলেই চারটি যাত্রী ট্রেনের মধ্যে থেকেও বিচ্ছিন্ন।
মোট কথা, এই শ্রেণীর যাত্রীদের মান এবং মর্যাদা সম্পর্কে রেল কর্তৃপক্ষ কিছুটা সচেতন। তা যত গুড় তত মিষ্টি। এয়ার-কনডিশন আরো আরামের, এরোপ্লেনে ততোধিক, আর এই গুড় যদি নিজের পকেট থেকে ঢালতে না হয় তাহলে যাকে বলে মিষ্টি মধুর। এই যাত্রায় আমি চলেছি সম্মানিত অতিথি হিসেবে একজন সহযাত্রীর কাঁধে ভর করে যিনি পকেটের পরোয়া করেন না। ফলে আমার দিক থেকে এটি নির্ভেজাল আনন্দ-যাত্রা। আনন্দের আরো কিছু ফিরিস্তি দেওয়া যেতে পারে। কোন ভবঘুরের উক্তি, আপনার বেড়াবার আনন্দ অনেকখানি নির্ভর করছে আপনার সহযাত্রীর ওপরে। সহযাত্রী বা যাত্রীরা যদি স্বল্পভাষী অথচ রসিক হন তাহলে আপনি ভাগ্যবান, তিনি বা তারা যদি আপনার থেকে বাকপটু হন তাহলে আপনার ভাগ্যটা মাঝারি, আর যদি পলকা বাক্যবাগীশ হন তো আপনার দুর্ভাগ্য। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একটি মাত্র যদি সুদর্শনা রমণী থাকেন আর তিনি যদি সহযাত্রীর ওপর হাবভাবেও সামান্য একটু সহৃদয়া হন আর অল্পসল্প মিষ্টি হাসেন আর একটু-আধটু কথা বলেন তো আপনার ভাগ্যের তুলনা নেই–পথ যত দীর্ঘ বা ক্লান্তিকর হোক, আপনার ভিতরটা রংদার তাজা ফড়িংয়ের মত আনন্দের ডালে ডালে ঘুরেফিরে বেড়াবে।
তা আমি এ-যাত্রায় প্রায় সব দিক থেকেই তুলনারহিত ভাগ্যবান। চার বার্থের এই অভিজাত কম্পার্টমেন্টে আমাকে বাদ দিলে আর দুজন সহযাত্রী এবং একজন সহযাত্ৰিনী। ভদ্রলোক দুজনের একজনের বয়েস পঁয়তাল্লিশ একজনের বড়জোর পঁয়ত্রিশ। তারা মামাতো-পিসতুতো ভাই। এ-যাত্রায় ওই পঁয়তাল্লিশ, ভদ্রলোকটির গৌরী সেনের ভূমিকা। নাম তার যাই হোক, সকলে মজুমদার মশাই বা বড়বাবু বলে ডেকে থাকে। বাংলা ছায়াছবির মোটামুটি নামী প্রযোজক অর্থাৎ প্রোডিউসার তিনি। এতদিন নিতান্ত মাঝারি প্রোডিউসার ছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি পর পর তার দুখানা ছবি ঊর্ধ্ব মার্গের বক্স অফিস হাট। সেই বিত্তের হিড়িকে রাতারাতি বৃত্ত বদল হয়ে গেছে তার। প্রযোজনার সামনের সারিতে এসে হাজির হয়েছেন। সেই দুখানা ছবিই রিলিজের পর পর আমি দেখে নিয়েছিলাম এবং আশাহত হয়েছিলাম। খরচের টাকা উশুল হবে কিনা সংশয় ছিল। কিন্তু সব সংশয় বরবাদ করে ভদ্রলোক প্রমাণ করেছেন বাংলা ছবির দর্শক-মনের কত নির্ভুল বিচারক তিনি। দুবছরে পর পর দুখানা ছবি। তাক লাগানো ভাবে লাগিয়ে দিয়ে এখন সাদা আর কালো টাকার হিসেব-নিকেশে মশগুল হয়ে আছেন। এবারে তার, যাকে বলে একখানা প্রেস্টিজ ছবি করার বাসনা। কিন্তু প্রযোজকের শুধু প্রেস্টিজ ধুয়ে জল খেলে চলে না। কাগজওয়ালারা গত দুটো হট ছবির একটিরও সদয় মন্তব্য করেনি। অতএব এবার নাম চাই আর সেই সঙ্গে টাকাও চাই।
অনেক খেটে অনেক জল্পনা-কল্পনা করে এই প্রেস্টিজ ছবির যে গল্প বাছাই করা হয়েছে, ভাগ্যক্রমে সেটা আমারই লেখা। সত্য কথা বলতে কি, আমি নিজেই একটু অবাক হয়ে গেছলাম। আগের ওই সুপারহট পিকচার যারা করেছেন তাদের কেউ এ গল্পের ছায়া মাড়াতে পারেন, ভাবিনি। কিন্তু আমার ভাবনা নিয়ে তো আর জগৎ চলছে না, আর বলা বাহুল্য, এই ব্যতিক্রমের ফলে অন্তত ভদ্রলোকের সম্পর্কে ধারণা অনেকখানি বদলেছে। এখন আমার ধারণা, টাকা কি করে করতে হয় ভদ্রলোক জানেন, সেই সঙ্গে ভালো-মন্দের বিচার-বোধও আছে। ব্যবসায়ী হিসাবে গল্পের দাম নিয়ে প্রথম দফায় কিছু ঝকাঝকি করেছেন আমার সঙ্গে, ফয়সলা হয়ে যাবার পর তিনি ভিন্ন মানুষ।
দিলদরিযা অতিথি-বৎসল। গল্পের আলোচনার জন্য বাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে। অনেক খাইয়েছেন। এই ছবিতে নিযুক্ত নামী পরিচালকটির কাছে নিজের বক্তব্য শেষ করার জন্য আমাকে ঠেলে দিয়েছেন। লক্ষ্ণৌতে আউটডোর শুটিং-এ চলেছেন। এঁরা। ইউনিট নিয়ে পরিচালক দুদিন আগেই যাত্রা করেছেন। মজুমদার মশাই, অন্যথায় বড়বাবু, ইনকাম ট্যাক্সের ব্যাপারে আটকে পড়েছিলেন বলে দুদিন পরে যাচ্ছেন। বড়বাবুর সর্বকাজের প্রধান দোসর তার এই পিসতুতো ভাই হিরন্ময় বা হিরু গুপ্ত। বড়বাবু না নড়লে তারও নড়ার উপায় নেই। অতএব ম্যানেজারির ভার অন্যের ওপর চাপিয়ে সে-ও দুদিনের জন্য পিছিয়ে গেছে। আমার সঙ্গী হবার বাসনাটা সে-ই বড়বাবুকে জানিয়েছিল, শোনামাত্র ভদ্রলোক আমাকে দরাজ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।