একবার একদঙ্গল মেয়ের মধ্যে থেকে একটি উদ্বাস্তু মেয়েকে আর স্টুডিওতে না নিয়ে গিয়ে সোজা নিজের ঘরে তুলল বৃন্দাবন। সেই মেয়ে অমলের মাসতুতো দিদি শ্যামা। কালোর উপরে দিব্যি সুশ্রী মেয়ে। আর চৌকসও। ঠারেঠোরে তাকাতে জানে, হাসতে জানে। এই মেয়ে কর্তার চোখে পড়লে আর রক্ষা নেই জানে। চোখে পড়তে দিল না। নিজেই বিয়ে করে বসল। দিন কয়েক বাদে শ্যামা তার মাসতুতো ভাই অর্থাৎ অমলকেও তার নিজের সংসারে টেনে নিয়ে এল। অমলেরও আর তিনকুলে কেউ নেই।
কিন্তু বৃন্দাবনের সংসার বেশিদিন টিকল না। তার ঘরে ছবির জগতের নীচু পর্যায়ের কর্মীদের আনাগোনা ছিলই। কিছু দিনের মধ্যেই শ্যামার চোখ খুলে গেল। বৃন্দাবন ওকে বিয়ে করে বঞ্চিত করেছে কানে এমন মন্ত্র দেবারও লোক জুটল। তার ওপর স্বামীটি কি কাজ করে বেড়ায় জানার পর থেকে শ্যামা বীতশ্রদ্ধ তার ওপর। কতদিন আঁঝের মুখে বলে বসেছে, তুমি আবার একটা মানুষ নাকি, কোনদিন তোমার মনিবের হুকুম হলে আমাকেই পাঠিয়ে দেবে তার কাছে-তুমি না পারো কি?
বৃন্দাবন পাল মনে মনে ভাবে মনিবের হুকুম হলে শ্যামা আর তার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবে না, ছবিতে নামার আশায় নিজেই ছুটবে তার কাছে। মেজাজ ভাল থাকলে শ্যামা অনেকদিন মালিকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার কথা বলেছে।
যাই হোক, দুবছর না যেতে শ্যামা নিজেই তার ব্যর্থ জীবন সফল করতে ঘর ভেঙে দিয়ে চলে গেল। এক রাত্রিতে বৃন্দাবন ফিরে দেখে বউ ঘরে নেই। আর দিন দুই যেতে বুঝে নিল ওই বউ ঘরে আর ফিরবেও না।
কিন্তু চির অনুগতের মতই অমল দাস থেকে গেল তার কাছে। বউ চলে যাবার পর কিছুদিন পর্যন্ত সমস্ত মেয়ে জাতটার ওপরেই ঘেন্না ধরে গেছল বৃন্দাবনের। সেই ঘেন্নার ভাগ অমল দাসও নিয়েছিল। দুই এক বছর যেতে বৃন্দাবনের মন বদলেছে। আবার সে সুখের সংসার করার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অমল দাসের মন বদলায়নি। বৃন্দাদার কাজে সে যথেষ্ট সাহায্য করে বলেই ঘেন্না তার আরো বেড়েছে। মেয়েগুলোই দুনিয়ায় যত অনিষ্টের মূল ভাবে সে। বৃন্দাদাকে সে সাহায্য করে সম্পূর্ণ নিরাসক্তভাবেই। কসাইয়ের যেমন মাংস কাটা কাজ, অনেকটা সেই রকমই মনোভাব। বৃন্দাদার দিন ফিরলে তারও দিন ফিরবে এটুকুই আশ্বাস। কিন্তু দিন ফিরলেও কোন মেয়েকে নিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখে না সে।
এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন একটা কাণ্ড হয়ে গেল। কলকাতার দিনকাল তখন। খুব খারাপ। হামলা মারামারি কাটাকাটি লেগেই আছে। কিন্তু অমল নিঃশত্রু ভাবে নিজেকে, তাই রাত্রিতেও নিঃশঙ্কে চলাফেরা করে।
সবে রাত তখন আটটা সাড়ে আটটা হবে। স্টুডিওর পিছনের নির্জন রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছিল। বৃন্দাদার জন্য অর্থাৎ তার মালিকের জন্য একে একে তিনটে মেয়ের কাছে টোপ ফেলেও বিফল হয়েছে। ফলে ভিতরটা তেতে আছে তার। দুনিয়া থেকে মেয়েগুলোকে নির্মূল করে দিতে পারলে দিত। ওই বুড়ো হাঙর অর্থাৎ বৃন্দাদার মালিকের বিকৃত আনন্দের নিবৃত্তি যে কবে হবে তাও জানে না।
উঁচু রাস্তা, দুদিকে পোড়ো জমির ঢল। হঠাৎ অন্ধকারে মেয়ের গলার গোঙানি শুনে থমকে দাঁড়াল। হ্যাঁ, স্পষ্টই একটা চাপা আর্তস্বর কানে আসছে বাঁদিকের ঢল থেকে। অন্ধকারে ঠেকে-ঠোকে নীচু জমির দিকে পা বাড়ালো। আধা-আধি নেমেই সর্বাঙ্গ অবশ। সামনেই পুঁটলির মত পড়ে আছে একটা মেয়ে, অতি যন্ত্রণায় সে-ই কাতরাচ্ছে।
অমল দাস ঝুঁকে দেখল। তারপর পকেট থেকে দিয়াশলাই বার করে হাঁট মডে বসে দিয়াশলাই জ্বালল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই কাঠিটা নিভে গেল আবার।
অমল দাস তার মধ্যে যা দেখার দেখে নিল। বছর উনিশ কুড়ির একটা অপুষ্ট মেয়ে। কিন্তু বেশ সুশ্রী মুখখানা। এক পিঠ চুল। হাত পা গা ছিঁড়ে রক্ত ঝরছে।
কি যে করবে অমল দাস ভেবে পেল না। কিন্তু মেয়েটাই ককিয়ে উঠল, আমাকে তোলো
অমল মেয়েটাকে টেনে বসাল। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। একটু বাদে ওকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আমাকে বাঁচাও, ছুঁচোগুলো ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে আমার হাড়গোড় ভেঙে দিয়েছে! একটু জল খাব–
কিন্তু জল কোথায় মিলবে সেখানে? অমল টেনে তুলল তাকে। তারপর একরকম আলতো করেই রাস্তায় এনে দাঁড় করাল। পরনের জামা-কাপড় যেভাবে ছিঁড়েছে। আলোর দিকে যাবে কি করে ভেবে পেল না।
অন্ধকারে ভেঁপু বাজিয়ে একটা রিকশা আসছে। অমল দাস অন্য কোন দিশা না পেয়ে তাতেই উঠে বসল মেয়েটাকে নিয়ে। সেও প্রায় কোলে করে তুলতে হল। রিকশাওলাকে কৈফিয়ত দিল, হঠাৎ পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছে, তাই
রিকশাওলাটা বিহারী। চাপা গলায় অমল মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাড়ি কোথায়? কোথায় যাবে?
কিছু জবাব পেল না। পিছনে মাথা এলিয়ে বেহুশের মত পড়ে আছে মেয়েটি। ধাক্কা দিল। কোন সাড়া নেই।
অমল ঘামতে শুরু করেছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে রিকশা নিয়ে সোজা নিজেদের ডেরায় চলে এল। দরজা খোলা দেখে আর আলো দেখে বুঝল বৃন্দাদা ঘরে আছে। একলাফে নেমে দু-এক কথায় ব্যাপারটা বলে তাকে টেনে নিয়ে এল। .. অজ্ঞান হয়ে আছে, তাকে নিয়ে এখন কি করা হবে?
কিন্তু বৃন্দাদাকে নিয়ে রিকশার কাছে এসে অমল হাঁ। মেয়েটা রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে যন্ত্রণার ছাপ। নিঃশব্দে কাঁদছেও।