অমল দাস জবাব দেয় না, গুরুটি তার জবাবের প্রত্যাশাও করে না। নিজের অনাগত সুখ-স্বপ্নে বিভোর সে। তার বয়েস এখন উনচল্লিশ। আর এক আধ বছরের। মধ্যে দিন বদলাবে। নিশ্চয় বদলাবে। তখন ভোগের বন্যায় গা ভাসাতে বাধা কোথায়। সমস্ত রকমের কাল্পনিক বাধা একের পর এক নাকচ করে দিয়েছে। টাকা থাকলে সব বাধা জল। আর বয়েসটা তো কোন বাধাই নয়। তার মনিব এই বাহাত্তর বছরেও ভোগী। অবশ্য ভোগের সাধ যত আছে এখন আর সাধ্য তত নেই। তার ফলে যে সব কাণ্ড করে আনন্দ পেতে চেষ্টা করেন ভাবতে গেলে বৃন্দাবনের একটুও ভাল লাগে না। অত বয়সে ভদ্রলোকের একটু ধম্ম কম্মে মতি ফিরলে বরং বৃন্দাবনের সুবিধে হত। না, অত বয়সে বৃন্দাবন মনিবের মত হ্যাংলাপনা করবে না। বড় জোর ষাট বছর পর্যন্ত আনন্দের সময়। চল্লিশে তার দিন ফিরলেও আনন্দের ঢের সময়। পড়ে থাকবে। কম করে বিশটি বছর। অতএব তার হতাশ হবার কিছু নেই।
এ-সব কথা সে হামেশাই অমলকে শোনায়। অমল তার ভোগের ছটকাও কিছু কিছু জেনেছে। যেমন; একটা ভাল বাসায় থাকবে, ভাল জামা-কাপড় পরবে, একটু ভাল খাবে-দাবে, আর মনের মত একটা মেয়ে এনে ঘর বাঁধবে।…ওই পোড়ারমুখি যদি কোথাও থেকে তাকে দেখে তখন, হিংসেয় কালি হয়ে যাবে।
পোড়ারমুখিটা কে তাও অমল ভাল জানে। তারই মাসতুতো দিদি শ্যামা। সম্পর্কে অমল বৃন্দাবনের মাসতুতো শ্যালক। দুজনকেই একসঙ্গে আশ্রয় দিয়েছিল বৃন্দাবন। অমলের তখন পনের বছর বয়েস আর মাসতুতো দিদির একুশ। আর বৃন্দাবন পালের তখন একত্রিশ। অমলের বয়েস এখন তেইশ আর শ্যামাদি আজ যেখানেই থাক– তার উনত্রিশ।…শ্যামাদি বৃন্দাদার ঘর করেছে মাত্র দুটি বছর। তার মধ্যেই অনেকবার ঘর ভাঙার দাখিল হয়েছে, তবু কোন রকমে টিকে ছিল। বৃন্দাবন পাল তার মনিব সুমন্ত চৌধুরীর খাস সরকার আর মোসাহেব ছিল তখন। ফাঁই ফরমাশ খাটা বা হঠাৎ দরকারে ছোটাছুটির জন্য কর্তার ড্রাইভারের পাশে বসে স্টুডিওতেও আসতে হত। স্টুডিওর অনুগ্রহ-প্রত্যাশীদের কাছে সেই কারণে তার কদরও ছিল একটু। কর্তাটি ছবির রাজ্যের নামজাদা প্রডিউসার।
নিজের গুণেই বিশেষ নজরে পড়েছিল সে। দুদুটো ছবির ভবিষ্যত ভেবে কর্তা যখন মুষড়ে পড়েছিলেন, তখন টেকনিশিয়নদের সঙ্গে স্টুডিওতে সেই ছবি তন্ময় হয়ে দেখে বৃন্দাবন ছাড়া ওরকম ভবিষ্যদ্বাণী আর কেউ করেনি, কারণ কর্মকর্তারা মালিকের দুশ্চিন্তার ভাগ নেবার ফলে ভবিষ্যত সম্পর্কে রায় তেমন আশান্বিত হয়ে উঠতে পারেনি। বোকার মত সেই ছবিই হিট করবে রায় দেবার ফলে; তখনকার মত বৃন্দাবন বরং মালিকের বিরক্তিভাজন হয়েছিল। কিন্তু, সত্যি সত্যি সেই দুটো ছবিতেই অপ্রত্যাশিত ভাল লাভ হয়েছিল মালিকের। চৌধুরীমশায় সেইজন্য তাকে পুরস্কারও দিয়েছিলেন। এরপর দুদুটো প্রেস্টিজ ছবি করেছিলেন কর্তা। মালিকের। সঙ্গে সকলে একবাক্যে রায় দিয়েছে–ছবি হয়েছে বটে, একেবারে হাট! চৌধুরীমশাই সাগ্রহে বৃন্দাবনের মতামত জানতে চেয়েছেন। কিন্তু মাথা চুলকে সে বলেছে, আমি সবটা ঠিক বুঝতে পারিনি হুজুর-একটু হাই জিনিস তো…।
অন্য মোসাহেবরা হেসে উঠেছে। কর্তা নিজেও। কিন্তু ছবির ফলাফল দেখে সকলের চক্ষুস্থির। ওই দুই ছবিতে বহু টাকা লোকসান হয়েছিল মালিকের।
ফলে কর্তার কাছে বৃন্দাবনের খাতির আরো বেড়ে গেছে। বৃন্দাবনের ভাল লাগলে তবে তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করেন। এই করেই ছবির ব্যাপারে জড়িয়ে পড়তে লাগল বৃন্দাবন পাল। একটা দুটো করে কাজের ভার পড়তে লাগল তার ওপরে। বারকয়েক আধাবস্তি গোছের গরিব মহলে হানা দিয়ে ছবির জন্য কিছু একস্ট্রা মেয়ে সংগ্রহ করে দেবার ফলে এই কাজটাই ক্রমশঃ তার ওপর বর্তাল। নায়িকা বা সহ নায়িকা ছাড়াও এক সীন দুসীনের জন্য অনেক ভদ্র চেহারার মেয়ের দরকার হয়। দিন পিছু তাদের তিন টাকা পাঁচ টাকা রেট আর দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। এই কাজেই দস্তুরমত নাম কিনে ফেলল বৃন্দাবন পাল। সে যে-সব মেয়েদের আনে তাদের বেশির ভাগই মোটামুটি ভদ্র চেহারার, কেউ কেউ কথাবার্তাও কইতে পারে বেশ, আবার দুই একজন সুশ্রী মেয়েও বেরিয়ে যায় তাদের মধ্যে। ছবিতে মেয়েদের কোন ভিড়ের রোল থাকলেই বৃন্দাবন পালের কাজ বাড়ল।
কর্তা এ-কাজের জন্য একটা অল সেকশন ট্রামের মান্থলি টিকিট বরাদ্দ করে দিয়েছেন তাকে। আর মাইনেও কিছু বাড়িয়েছেন, কারণ, এ-কাজে একটু ভদ্র জামা-কাপড় দরকার।
বৃন্দাবন পাল সোৎসাহে এই কাজ করে চলেছিল। কিন্তু মুশকিলে ফেললেন তাকে কর্তা নিজেই। এক্সট্রা মেয়েদের মধ্যে কাউকে মনে ধরলেই ওকে ডেকে কানে কানে কিছু প্রস্তাব করেন। উদার মুখে দশ পাঁচ টাকা আগাম বখশিসও করে ফেলেন। তাকে। ওই প্রস্তাব শুনে গোড়ায় গোড়ায় ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করত বৃন্দাবন পাল। কিন্তু ভগবানের নাম করে সেই দুরূহ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে হয়নি। কর্তার নাম করে ভবিষ্যতের অনেক রকম লোভ-টোভ দেখিয়ে যেভাবেই হোক কর্তার পছন্দের রমণীটিকে বশে আনত। দেরি হলেও লেগে থাকত, কিছু খরচপত্র করত এবং শেষ পর্যন্ত বিফল হত না।
…কিন্তু মালিকের এই রোগ বাড়তেই থাকল। ছবির জন্য একস্ট্রা মেয়ের কোন সীন না থাকলেও কর্তার ঝোঁক চাপলে তার মনের মত মেয়ে সংগ্রহের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হয় তাকে। সে রকম কাউকে পেলে কর্তা দরাজ হাতে টাকা দেন, আবার সেরকম না হলে তার পছন্দের খোটাও দেন। এই ফরমাশ খাটতে গিয়ে এক একসময় গলদঘর্ম হয়ে ওঠে বৃন্দাবন পাল।