ও পাশের বেডে যে মেয়েটি থাকে তার বছর তিরিশ বয়েস। কিন্তু এরই মধ্যে কঠিন রোগ বাধিয়ে বসেছে। পেটে জল হয়েছে নাকি। দেখতে বেশ সুশ্রী। কিন্তু বড় বেশি রকম অবুঝপনা আর বায়নাক্কা। রোজ চারটে বাজতে না বাজতে মেয়েটির স্বামী দেখতে আসে ওকে-কালো মোটাসোটা, বছর চল্লিশ হবে বয়েস। সচ্ছল অবস্থা বোঝা যায়। রাধারাণী শুনেছেন কাগজের কারবার তাদের। লোকটি রোজই কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসে। দুর্মুল্যের ফল, দামী দামী টনিক ফুড, গল্পের বই, শখের ব্লাউস, রুমাল, এমনকি গয়নাও। রাধারাণী দূর থেকে লক্ষ্য করেন, কিছুতে যেন মন ওঠে না মেয়েটার–কোনো কিছুতেই তুষ্ট নয়। লোকটি ঘড়ি ধরে পুরো দুঘণ্টই বসে থাকে তার শয্যার পাশে, স্ত্রীর সব কথাতেই সায় দেয়, সব আক্ষেপে সান্ত্বনা দেয়। দু-তিনদিন অন্তর বছর আটেকের একটি ছেলেও আসে বাপের সঙ্গে মাকে দেখতে। রাধারাণী শুনেছেন, ওই একটিই ছেলে ওদের, পুরনো ঝিয়ের জিম্মায় থাকে, বাড়িতে আর দ্বিতীয় কেউ নেই।
রাধারাণী অবাক হয়ে ভাবেন, ছেলেটা রোজ আসে না কেন, আর ওই মা-ই বা ছেলেকে রোজ না দেখে থাকে কি করে! ওদিকে স্বামীটির আসতে আধ মিনিট দেরি হলে আধঘণ্টা তার জের চলতে দেখেছেন রাধারাণী। অনেক অনুনয় অজুহাত সাধ্য-সাধনায়ও সহজে মন গলে না। রাধারাণীর এক একসময় রাগই হয় মেয়েটার ওপর, অত পায় বলেই পাওয়ার ওপর এতটুকু শ্রদ্ধা নেই। হত তার ঘরের লোকটির মত, এক দাবড়ানিতে সব ঠাণ্ডা।
যাই হোক, এখানকার এত সব সুব্যবস্থার মধ্যে এসে পড়েও রাধারাণীর মনের তলায় কোথায় যেন যাতনার মত একটু। দু-বেলা খাবার সময় মন বেশ খারাপ হয়। দীর্ঘকালের রক্তাল্পতার রোগী তিনি, হাসপাতালের নির্দেশ অনুযায়ী আহারের রাজসিক ব্যবস্থা। মাছ-মাংসর ছড়াছড়ি। রাধারাণী অর্ধেকও খেয়ে উঠতে পারেন না। এমনি একটুকরো মাছ বাড়িসুদ্ধ লোকের একবেলার বরাদ্দ। এখন খরচের ধাক্কায় তাও জুটছে না নিশ্চয়। মেয়েটা কলেজের আগে ছেলেটাকে সময়মত দুটো ভাত ফুটিয়ে দিতে পারে কিনা তাই সন্দেহ। তার ওপর উঠতে বসতে বাপের বকুনি তো আছেই-বকুনির চোটেই এখন সারা হল বোধ হয় দুটোতে।
সঙ্গে সঙ্গে সামনের বেডের মেয়েটির কথা মনে হয়, আর তার স্বামীর কথা। অবশ্য সাত তাড়ার মধ্যেও ভূতনাথবাবু প্রায় রোজই একবার করে দেখে যান তাকে। দরকারী ওষুধ-পত্র সবই কিনে দেন, তারও মিটসেফে ফলমূল, থাকে কিছু। কিন্তু সে-সবই কিসের বিনিময়ে আসছে সেটা রুক্ষ মূর্তিটির দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায়। ভিতরে ভিতরে গুমরে ওঠেন রাধারাণী, এতবড় অসুস্থতার চিন্তাটাও মানুষটার সব থেকে বড় চিন্তা নয় যেন, এখানে এসেও দু-দণ্ড হাসিমুখে কথা বলার নাম নেই। ফলে মেজাজ সব দিন রাধারাণীরও ঠিক থাকে না, এক কথায় তিন কথা শুনিয়ে দেন। বিশেষ করে ওই বেডের মেয়েটির স্বামীটিকে দেখে দেখে তার সহিষ্ণুতা কমেছে অন্যের ঘরে কি, আর তার ঘরেই বা কি…।
সেদিন ভূতনাথবাবু আসতে ইঙ্গিতে রাধারাণী ওই মেয়েটিকে দেখিয়ে কথায় কথা বললেন, কাল সরস্বতীপূজো উপলক্ষে ওর স্বামী ওকে চমৎকার একজোড়া ফরাসডাঙর শাড়ি এনে দিয়েছে–আমাকে আবার ডেকে দেখাল।…ভদ্রলোক কত তোয়াজে রেখেছে মেয়েটাকে, রাধারাণী সেই গল্পও করলেন।
ভূতনাথবাবু হঠাৎ রুক্ষ বিরক্তিতে বলে উঠলেন, আমার তো সাধ্য নেই তোমাকে এখন ফরাসডাঙার শাড়ি এনে দিই–এইতেই তো শেষ হয়ে গেলাম।
শুনে রাধারাণী গুম হয়ে বসে রইলেন। তিনি শাড়ি চাননি। ওই রকম মন চেয়েছিলেন। ওই রকম অনুরাগটুকুই লোভনীয় ছিল।
এক মাসের মাথায়, এই ঘরে একটি মর্মান্তিক ব্যাপার ঘটল।
ওই মেয়েটার স্বামী দুঘণ্টার জায়গায় চার-ঘণ্টা ছ-ঘণ্টা কাটিয়ে যেতে লাগল। শেষ অবস্থা বলেই অনুমতি মিলেছে বোধ হয়।
সেদিন দুপুর থেকেই অক্সিজেন চলছে।
রাধারাণীর বুকের ভিতরটা সারাক্ষণ কাঁপছে থরথর করে। ওই মেয়েটার ভাগ্যর ওপর চোখ দিয়েছিলেন বলে ভিতরে ভিতরে অপরিসীম যাতনা একটা। দুপুরে খুব কেঁদেছেনও, আর প্রার্থনা করেছেন, ঠাকুর ওকে বাঁচিয়ে দিও!
সন্ধ্যে থেকে তার স্বামী নিজেই অক্সিজেন ধরে বসে আছে। শান্ত বিষণ্ণ মূর্তি। রাধারাণীর সেদিকে তাকাতেও কষ্ট।…একসময় দেখলেন, লোকটি অক্সিজেনের নল রেখে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। চুপচাপ স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। তারপর বুকের কাছে মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ল।
রাধারাণী চমকে উঠলেন। বুকের ওপর ভেঙে পড়বে নাকি এখনো যে শেষ হয় নি। অবশ্য শেষ হতে বাকিও নেই…কিন্তু লোকটা করছে কি!
রাধারাণী হঠাৎ নিস্পন্দ কাঠ একেবারে।
লোকটি মেয়েটির গলার হার, কানের দুল, হাতের চুড়ি, বালা, আঙটি, সব একে একে খুলে পকেটে ফেলল। তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
আধঘণ্টার মধ্যে সব শেষ। ডাক্তার মাথা নেড়ে চলে গেলেন। রাধারাণীর বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত তখনো। চেয়ে আছেন বিস্ফারিত নেত্রে। দেখছেন।
…লোকটি শান্ত মুখে একটা ঝোলার মধ্যে স্ত্রীর শাড়ি কটা নিল, মিটসেফ খুলে নিজের আনা বোতলের খাবার আর টনিকগুলো দেখে দেখে পুরল, তারপর ভালো করে স্ত্রীকে আর একবার দেখে নিয়ে শ্রান্ত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রাধারাণী চিত্রার্পিত।