সুমিত্রার জীবনে যথার্থই সংকটের কাল সেটা। রাশভারী বাবাকে কিছু বলা যাচ্ছে না। বলা যাচ্ছে না, কারণ ওখানে বিয়ে অনেক দিন ধরেই ঠিক। অথচ তিন বছর হল পিছনের বাড়ির এক ছেলের কাছে মন সঁপে বসে আছেন তিনি। গরীব ঘরের ছেলে। স্কলারশিপ পেয়ে নিজের পড়াশুনা চালাচ্ছেন। কোন এক দুর্বল মুহূর্তে সেই ছেলেও সুমিত্রার আশ্বাস পেয়ে ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন। বড়লোকের হবু ব্যারিস্টার ছেলের মনের মত অনেক মেয়ে জুটবে, কিন্তু কথার খেলাপ করলে এই ছেলের বুক ভেঙেই যাবে একেবারে।
সেই সংকটের ফলে জীবনে একটাই মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছিল তাকে। মাকে স্পষ্ট করে বলেছেন, বাবাকে জানিয়ে দাও এ বিয়েতে আমার আপত্তি আছে।
মা আকাশ থেকে পড়েছিলেন একেবারে।সে কি রে! কেন?
কেন আবার কি! সুমিত্রা মরিয়া একেবারে।–বড়লোকের ছেলে, এখনই মদের নেশা, পরে আরো কত গুণ দেখা যাবে কে জানে। আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি, আমার আপত্তি আছে।
ওই একটা জিনিস বাবা আন্তরিক ঘৃণা করেন সুমিত্রার সেটা খুব ভাল জানা ছিল। এই এক কারণে বাবার সঙ্গে কাকার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। অতএব আর কোন উপায় না দেখে সুমিত্রা এই পথ ধরেই সংকট কাটিয়ে উঠতে চেয়েছেন। হবু ব্যারিস্টারের বাড়িতে এ কথা তো কোনদিন প্রকাশ হবে না, তাদের আর এমন কি ক্ষতি। বিয়েটা নাকচ হবে শুধু।
নাকচ হয়েছে। সুমিত্রার ধারণা বাবা শুধু তাদের জানিয়ে দিয়েছেন মেয়ের আপত্তির কারণে এ বিয়ে হল না। এ ছাড়া আর বলার কি আছে?
তারপর কথা যাঁকে দেওয়া হয়েছে সময়ে তাকেই বিয়ে করেছেন তিনি। সুমিত্রা সিংহ হয়েছেন।
নিজের ভিতরে কোন সুপ্ত অপরাধবোধ ছিল কিনা সুমিত্রা সিংহ জানেন না। নইলে পঁচিশ বছর বাদে এক মেয়ের মুখের আদল দেখে অবচেতন মনে হঠাৎ ওই রকম নাড়া পড়েছিল কেন!
না, স্কুল থেকে তাড়িয়ে ওই সুশ্রী মেয়েটাকে জাহান্নমের পথে ঠেলে দেবেন না সুমিত্রা সিংহ। বরং এই মানসিক আবর্ত থেকে ওকে টেনে তুলতে পারাটাই যেন ভাল কাজ হবে, উদারতার কাজ হবে।
স্কুলের একজন ড্রাইভারকে বলে রেখেছিলেন। সন্ধ্যার পর সে তাকে নির্দিষ্ট ঠিকানায় নিয়ে এল।
সুমিত্রা সিংহ কার্ড পাঠালেন।
কিন্তু তারপরেও কম করে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হল। ভাবলেন, কোন। কেস নিয়ে ব্যস্ত বোধহয়।
কিন্তু নীতিশ বোস ঘরে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভুল ভাঙল। আঁ করে একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল। লোকটার থঙ্কলে লালচে মুখ। টানা দু চোখ ঈষৎ আরক্ত। নেশার মধ্যপথে উঠে আসতে হয়েছে বলেই হয়তো ভুরুর মাঝে ভাজ।–সীট ডাউন প্লীজ।
সুমিত্রা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, বসলেন আবার। ভিতরটা মুহূর্তের মধ্যে বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেছে। আশ্চর্য, সেই সঙ্গে স্বস্তিবোধও। কোন এক দিনের মিথ্যাচারের সুপ্ত অপরাধটুকু আজ অন্তত ধুয়ে মুছে গেছে।
নীতিশ বোসের এবারে হঠাৎ খেয়াল হল সামনে কাকে দেখছেন। পঁচিশ বছরের ফারাকেও সুমিত্রার চেহারা খুব বদলায় নি। বিশ্বাস করবেন কি করবেন না ভেবে পাচ্ছেন না। চোখ টান করে দেখছেন। হাতের কার্ডটা একবার চোখের সামনে ধরলেন। তারপর ভারী গলায় টেনে টেনে বললেন, তুমি সুমিত্রা সিংহ…ওই স্কুলের হেডমিসট্রেস।
ঈষৎ রূঢ় গলায় সুমিত্রা বাধা দিলেন, আপনি করে বলুন। আপনার মেয়ের কনডাক্ট সম্পর্কে একটু সীরিয়াস আলোচনার দরকার ছিল, কিন্তু আপনার পক্ষে এখন সেটা সম্ভব নয় মনে হচ্ছে।
মেয়েকে ওই স্কুলে রাখতে হলে স্কুল টাইমে গিয়ে দেখা করার কথা বলতে যাচ্ছিলেন। বলা হল না। নীতিশ বোসের নেশা-ছোঁয়া দুচোখ তার মুখের ওপর আটকে আছে। সঙ্গে সঙ্গে টানা ভারী গলাও শোনা গেল।-ওয়েট! আই ডোন্ট থিংক দ্যাট উইল বি নেসেসারি। আলোচনার দরকার নেই। দু আঙুলে সুমিত্রা সিংহর নাম লেখা কার্ডটা তুলে সামনে ধরলেন।–এই মহিলা যে স্কুলের প্রধান সেখানে আমার মেয়েকে রাখা আমি উচিত মনে করি না। আই উইল সেণ্ড হার ডিউস টুমরো মর্নিং অ্যাণ্ড গেট হার টি. সি. গুড নাইট!
চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন তারপর সৌখিন পার্টিশনের ওধারে চলে গেলেন।
স্কুল বাসে বাড়ি ফিরছেন সুমিত্রা সিংহ। দুর্বার রাগে নিশ্চল স্তব্ধ তিনি। এত বড় স্পর্ধার কথা জীবনে কেউ শোনায়নি তাকে।…কিন্তু বুকের ভিতরে কোথায় চিনচিন করে জ্বলছে।
আরোগ্য
আরোগ্য
ব্যবস্থা দেখে রাধারাণী খুশী।
জীবন এখানে যত্নের জিনিস, লালনের সামগ্রী। পায়ে পায়ে ক্ষয়ের খোড়ল হাঁ করে নেই। এখানে শুধু জীবনের মূল্যবোধটুকুই স্পষ্ট। চারদিক শুচিশুভ্র আরাম দিয়ে ঘেরা। বেশ ঠাণ্ডা নিরাপদ আরাম।
ঘরের দুই কোণে দুটো তকতকে বেড। এর অর্ধেকেরও অনেক ছোট ঘরে চারজনে থেকে অভ্যস্ত তারা, ওইটুকুর মধ্যেই একটা গোটা সংসার। বিবাহিত জীবনের বাইশ বছরের মধ্যে এই প্রথম যেন নতুন বাতাসের স্বাদ পেলেন রাধারাণী। বাঁচার আগ্রহ বোধ করতে লাগলেন, মনের তলায় এক ধরনের উৎসাহ উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল।
দিনে ছ টাকা চার্জ। তাও ভূতনাথবাবু ওপর-ওলাদের ধরে পড়ে অর্ধেক দক্ষিণায় রাজী করাতে পেরেছেন বলে। নইলে চার্জ বারো টাকা। কিন্তু দিনে ছ টাকাই রাধারাণীর কাছে আঁতকে ওঠার মত–মাসে একশ আশী টাকা। তার ওপর ওষুধ-পত্ৰ ফল টলে মাসে কম করে আরো পঞ্চাশ টাকার ধাক্কা–হল দুশ তিরিশ! শুনেই রাধারাণী বিগড়ে গিয়েছিলেন। কমাস থাকতে হবে কে জানে…। কিন্তু তিনি নিশ্চিত নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছেন দেখেই মুখ কালো করে ভূতনাথবাবু সরাসরি তাকে এখানে এনে ফেলেছেন। রাধারাণী সাহস করে আর আপত্তি করতে পারেন নি। মুখ খুললেই কুরুক্ষেত্র বাধবে জানেন, তখন আর ভদ্রলোক রোগিণী বলে রেহাই দেবেন না ওঁকে। ছেলেমেয়ের সামনেও এমন কথা বলে বসেন যে চামড়ার নিচে হাড়-পাঁজরসুদ্ধ খটখটিয়ে ওঠে। কিন্তু এখানে জীবন-রক্ষার উপকরণ দেখে রাধারাণীর মনে হল তাদের নেই-নইলে, এর তুলনায় দিনে ছ টাকা ছেড়ে বারো টাকাও কিছু নয়।