সুমিত্রা সিংহ ইশারায় রেসিডেন্সিয়াল টিচার আর মেট্রনকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বললেন।
তারা অনিচ্ছাসত্ত্বেই প্রস্থান করল। এই মেয়ের শাস্তিটাই বিশেষ করে চোখে দেখার ইচ্ছে ছিল বোধহয়।
ঘরের মধ্যে দুজনে মুখোমুখি এবার। চোখাচোখি।
অনুচ্চ কঠিন গলায় সুমিত্রা সিংহ জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম নন্দিতা বসু?
হ্যাঁ। আপনি আমার গায়ে হাত তুলবেন না, ইচ্ছে হলে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেন।
মুহূর্তের জন্যে সংযম হারালেন সুমিত্রা সিংহ। উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল থেকে বেতটা তুলে নিয়ে মেয়েটার কাধ বেড়িয়ে একটা প্রচণ্ড আঘাত করে বসলেন। কিন্তু ওই একটাই। সুশ্রী মেয়েটার রক্তবর্ণ মুখ এখন। চেয়ে আছে। প্রহারের জবাবটা যেন চোখ দিয়ে দিচ্ছে। সুমিত্রা সিংহ বুঝে নিলেন আঘাতে আঘাতে মাটিতে শুইয়ে ফেললেও এ মেয়ের মুখ দিয়ে কান্নার শব্দ বেরুবে না।
তার দরকারও নেই। সংকল্প মতই কাজ করবেন। কিন্তু মেয়েটার এই মুখের আদল কেন যেন বড় বেশি বিমনা করে তুলছে তাকে।
বসলেন আবার। তেমনি কঠিন গলায় ফের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মায়ের নাম কি?
সুজাতা বোস।
না, সুমিত্রা সিংহ এই নামের কাউকে চিনলেন না।
বাবার নাম কি?
নীতিশ বোস।
নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বুকের তলায় কি রকম একটা তোলপাড় কাণ্ড হয়ে। গেল সুমিত্রা সিংহর। একটা অস্পষ্টতার পর্দা সরে গেল চোখের সামনে থেকে। হ্যাঁ, অবিকল সেই নাক মুখ চোখই বটে। ঠোঁট বাঁকানোটা পর্যন্ত সেই রকম। জিজ্ঞাসা করার দরকার ছিল না, তবু প্রশ্নটা যেন আপনা থেকেই গলা দিয়ে বেরিয়ে এল।–কি করেন?
বার অ্যাট ল। হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন।
না, কোথাও ভুল নেই, বিয়ের পর নীতিশ বোসের ব্যারিস্টারি পড়ার জন্যেই বিদেশ যাওয়া স্থির ছিল।
দীর্ঘকালের শিক্ষয়িত্রী জীবনে এ রকম আর কখনো হয়নি। মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে চেষ্টা করেও নিজেকে আর অত কঠিন করে তুলতে পারছেন না। সুমিত্রা সিংহ। জিজ্ঞাসা করলেন, কলকাতাতেই বাড়ি, তবু তুমি বাবা মায়ের সঙ্গে থাক না কেন?
মেয়েটা সাদাসাপটা জবাব দিল, মা বাবার সঙ্গে থাকেন না, ডিভোর্স হয়ে গেছে। বাবা তাই আমাকে হস্টেলে রেখেছেন।
সব ভুলে সুমিত্রা সিংহ বিমূঢ় মুখে মেয়েটার দিকে চেয়ে রইলেন খানিক। মেয়েটা পড়াশুনায় এত ভাল, তা সত্ত্বেও এ রকম উজ্জ্বল হয়ে ওঠার কারণ যেন বুঝতে পারছেন তিনি। মেয়েটার কথা-বার্তায় আচরণে একটা চাপা ক্ষোভ স্পষ্ট।
তোমার বাবার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হতে পারে?
মেয়েটা টেলিফোন নম্বর বলে দিল।
কখন ফ্রী থাকেন তিনি?
সন্ধ্যার পর। সমস্ত দিন ব্যস্ত থাকেন।
আচ্ছা, তুমি যেতে পারো।
উদ্ধত মখেই মেয়েটা চলে গেল। সে কেমন করে যেন ধরে নিয়েছে অন্য কটা মেয়ের থেকে তার শাস্তি কঠিন হবে। অর্থাৎ বাবাকে বলে স্কুল থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে তাকে।
প্রায় আধঘণ্টা স্থাণুর মত চুপচাপ বসে রইলেন সুমিত্রা সিংহ। সাড়ে নটায় স্কুল, এখন সকাল সাড়ে দশটা। কি ভেবে ফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে নম্বর ডায়াল করলেন।
পেলেন।
বোস হিয়ার।
আমি আপনার মেয়ের স্কুলের হেড-মিস্ট্রেস মিসেস সিংহ।… আপনার মেয়ে নন্দিতার গ্রোস মিস কর্ডাক্টের সম্পর্কে আপনার সঙ্গে কথা হওয়া দরকার। তাকে আর এ স্কুলে রাখতে পারা শক্ত।
ওদিকের ভারী গলার স্বর থমকালো একটু।–কি মিস কনডাক্ট?
সেটা টেলিফোনে বলা সম্ভব নয়।
আই সি…বাট আই অ্যাম অফুলি বিজই…একমাত্র সন্ধ্যার পর বাড়িতে দেখা হতে পারে, বাট দ্যাট উইল বি পারহ্যাপস্ টু মাচ টু আস্ক
এদিক থেকে আরক্ত মুখে সুমিত্রা সিংহ বললেন, ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুতর এবং জরুরী–আপনার আসা দরকার।
বাট ইউ সি, আই কান্ট পসিবলি মেক এই টাইম। ঈষৎ অসহিষ্ণু কণ্ঠস্বর। ইউ ডু ওয়ান থিং ম্যাডাম, কাইন্ডলি সেণ্ড এভরিথিং ইন রাইটিং, আই উইল সি টু ইট। থ্যাঙ্ক ইউ।
রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ।
অসহিষ্ণু মুখে সুমিত্রা সিংহ ঘরের মধ্যে পায়চারি করে নিলেন খানিক। এরপর সোজাসুজি ওই মেয়ের বিরুদ্ধে চরম ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেবার কথা তার। তিনি সদয় হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লোকটার এত সাহস আর এত দম্ভ যে ঘুরিয়ে বাড়িতে দেখা করার কথা বলল। কিন্তু আশ্চর্য, এর পরেও তিনি যা করণীয় করে উঠতে পারলেন না। মেয়েটার প্রতি তার মায়া বাড়তেই থাকল। তার ধারণা, পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নিয়ে বিকৃত পথে চলেছে এমন ভাল মেয়েটা ৮ হ্যাঁ, এখনো তার উদার হবার ইচ্ছে। উদার হতে পারলে কোথায় যেন একটু শান্তিও। …প্রায় পঁচিশ বছর আগের একখানা মুখ চোখে ভাসছে তাঁর। ওই সুশ্রী মেয়েটার সঙ্গে মুখের আদল হুবহু মেলে যাঁর সঙ্গে তার। নীতিশ বোসের।
সুমিত্রার বয়েস তখন তেইশ। তখন সিংহ হননি। ঘোষ, সবে এম-এ পাশ করেছেন। এবারে নীতিশ বোসের সঙ্গে বিয়েটা হয়ে যাবার কথা। বাপে-বাপে বন্ধুত্ব। অনেক দিন আগে থেকেই কথা পাকা। বোসেরা বনেদী বড়লোক। সুমিত্রার বাবা-মা নিশ্চিন্ত। বিয়ের পরেই ছেলে বিলেত চলে যাবেন ব্যারিস্টারি পড়তে অতএব তার পক্ষে ঘন ঘন এ বাড়িতে আসার লোভটা স্বাভাবিক। নীতিশ বোস সপ্তাহে কম করে চার পাঁচদিন আসতেন আর সে রকম ফাঁক পেলে ভাবী স্ত্রীর ওপর একটু আধটু মিষ্টি হামলাও করে বসতেন। সুমিত্রাকে নিয়ে বেরুনোর তাগিদ দিতেন। কিন্তু সুমিত্রার দিক থেকে তেমন সাড়া পেতেন না বলে কখনো রাগ হত কখনো বা অভিমান।