ছেলেকে দেখে সহৃদয় ভদ্রলোকটির মন বিচলিত হল। বললেন, আচ্ছা বিকেল ঠিক চারটের সময় ছেলেকে সঙ্গে করে আমার সঙ্গেই চলো, আমি বাবাকে ধরে। পড়ব, আশাকরি ব্যবস্থা হবে।
কৃতজ্ঞতায় গৌরীনাথবাবু নির্বাক খানিক। এমন আশ্বাসের কথা দিল্লীতে এসে এই প্রথম শুনলেন। ফেরার পথে স্ত্রীর দুই চোখও ছলছল। মাঝে মাঝে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছেন। নীরব উচ্ছ্বাসের একটাই অর্থ যেন, তুমি চেষ্টা করলে হবে না এমন কিছু আছে নাকি!
.
ঘড়ি-ধরা সময়ে প্রাক্তন মন্ত্রীর সঙ্গে সেই ঈপ্সিত প্রাসাদের কাছাকাছি উপস্থিত হলেন সকলে। ভিড় তখন অপেক্ষাকৃত কম হলেও গাড়ি এগোবার উপায় নেই। খানিকটা তফাতেই নামতে হল। পিছনের ক্যারিয়ার থেকে তাড়াতাড়ি ফোলডিং হুইল চেয়ার বার করে ছেলেকে বসালেন। স্ত্রীও তৎপর হাতে সাহায্য করলেন তাকে। তারপর এগিয়ে চললেন।
সামনে দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রাক্তন মন্ত্রী। পিছনে হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে চলেছেন গৌরীনাথবাবু, পাশে স্ত্রী। ওঁদের দুজনেরই দুরু দুরু বক্ষ।
সামনের ভিড়ের অবরোধ সহজেই দুভাগ হয়ে গেল। এ সময়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে কে আসছেন ব্যবস্থাপকরা সকলেই জানে।
এবারে সামনে গেট। গেটের ওধারে সারি সারি ভলান্টিয়ার মোতায়েন। ছাড়পত্র না পেলে তারা একজনকেও ঢুকতে দেবে না। গেটের ও-ধারে লম্বা রাস্তার শেষে বাড়ি। সেখানেও বেশ জনাকতক ভাগ্যবান আর ভাগ্যবতীর সমাবেশ। ছাড়পত্র পেয়ে তারা কেউ বাড়ির মধ্যে ঢুকছে, কেউ বা ঢোকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
একজন ব্যবস্থাপক ভলান্টিয়ারদের কানে কানে কি বলতে বদ্ধ গেট একটুখানি খুলে প্রাক্তন মন্ত্রীকে ভিতরে ঢুকিয়ে নেওয়া হল। গৌরীনাথবাবু বা স্ত্রী বা হুইলচেয়ারে আসীন ছেলের ছাড়পত্র নেই। গেট আবার বন্ধ হয়ে গেল।
গেটের ওদিক থেকে সদাশয় প্রাক্তন মন্ত্রীটি গলা খাটো করে গৌরীনাথবাবুকে বললেন, এখানেই অপেক্ষা করো, আমি দেখি কি করতে পারি।
আবার অধীর প্রতীক্ষা। ভলান্টিয়াররা নিছক দয়া করেই বোধহয় তাঁদের তফাতে হটিয়ে দিল না। কিংবা হয়তো বুঝে নিল এরাও ফেলনা লোক নয়।
মিনিট দশেকের মধ্যে একজন ভলান্টিয়ার ভিতর থেকে ছুটে এলো।
গেটের সামনে এসে হুইলচেয়ারে বসা ছেলেকে দেখিয়ে বলল, একে ভিতরে নিয়ে আসুন, জলদি।
হুইলচেয়ার নিয়ে বদ্ধ গেট ঠেলেই তারা ভিতরে ঢোকার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাধা আবার।–ও নো নো! ওনলি ওয়ান। ছুটে-আসা ভলান্টিয়ারের ব্যস্ত-সমস্ত নির্দেশ।–রোগীর সঙ্গে আপনাদের যে-কোনো একজন আসুন, দুজন আসার নিয়ম নেই।
গৌরীনাথবাবু বিমূঢ় কয়েক মুহূর্তের জন্য। গেট আধখানা খোলা হয়েছে। জোর করে, দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে হুইলচেয়ার ঠেলে ভিতরে ঢুকতে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণে কাঁধের কাছে বেশ জোরেই একটা ঠেলা খেয়ে প্রায় নিজের অগোচরে একটু সরে গেলেন। তাজ্জব বিস্ময়ে দেখলেন স্ত্রী তাকে ঠেলে হুইলচেয়ারের দখল নিয়ে বলছেন, সরো সরো, তুমি পারবে না, আমি যাচ্ছি–
বাধা দেবারও অবকাশ পেলেন না গৌরীনাথবাবু। ছেলেসহ হুইলচেয়ার ঠেলে স্ত্রী গেটের ভিতরে ঢুকে পড়েছেন। চিৎকার করে বলতে গেলেন, তুমি তো রোগের নামটাও ঠিকমতো বলতে পারবে না
বলা হল না। হতভম্ব বিস্ময়ে দুচোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলেন তিনি। হুইলচেয়ার ঠেলে স্ত্রী তরতর করে যেন এক লক্ষ্যকেন্দ্রের দিকে এগিয়ে চলেছেন। স্ত্রীর এমন আত্মস্থ সমাহিত অথচ তৎপর মূর্তি আর বুঝি দেখেননি। নিষ্পলক চেয়েই আছেন গৌরীনাথবাবু। আর সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করছেন, ঠিক এই মুহূর্তে বাপের। তুলনায় ছেলের মায়ের সঙ্গে যাওয়াটার কত তফাৎ।
রাত আর দিনের মতই তফাত।