ভদ্রলোক বেচারা দোষ স্বীকার করে বললেন, দরজ, কপাট বন্ধ না করে এ রকম গর্হিত কাজ আর কখনো করবেন না।
ভদ্রমহিলা দ্বিগুণ আগুন হয়ে ঘর ছেড়ে প্রস্থান করলেন। এরপর কটা দিন মায়ের মেজাজ দেখে ছেলে মেয়ে অবাক। বাবার সামনেই কথায় কথায় আত্মসংযম সম্পর্কে ধারালো উপদেশ শুনতে হয়েছে তাদের।
সুমিত্রা সিংহ স্কুলে নিজের ঘরে বসে আছেন। কঠিন থমথমে মুখ। অসংযম আর শৃঙ্খলাভঙ্গের এক দারুণ নালিশ এসেছে তার কাছে। অপরাধী একেবারে উঁচু ক্লাসের পাঁচটি মেয়ে। স্কুল হস্টেলে থাকে তারা। নিজের স্কুলে এত বড় অপরাধের কথা তিনি ভাবতে পারেন না। কিন্তু অবিশ্বাস করার কিছু নেই। অপরাধের নজির তার সামনে। স্কুল লাইব্রেরির কতগুলো ঘেঁড়া-খোঁড়া বই। অসংযত ঘূর্তির উল্লাসে ওই মেয়েগুলো ছিঁড়েছে। বইয়ের নানা জায়গায় অশ্লীল মন্তব্য লেখা। সেও ওই মেয়েগুলোর কাজ। এ ছাড়া তাদের কতগুলো নোঙরা চিঠিচাপাটি হাতে নাতে ধরা পড়েছে। রেসিডেন্সিয়াল টিচার আর মেট্রন সেগুলোও হেডমিসট্রেসের কাছে দাখিল করেছেন।
সব দেখে শুনে সুমিত্রা সিংহর নিজেরই আত্মস্থ হতে সময় লেগেছে। তারপর ঠাণ্ডা মুখে ওই পাঁচ মেয়ের সম্পর্কে রিপোর্ট নিয়েছেন তিনি। পাঁচটি মেয়ের মধ্যে চারজন স্কুলের পুরনো ছাত্রী এবং মোটামুটি ভাল ছাত্রী। কেবল একটি মেয়ে নতুন। নাম নন্দিতা বসু। গেল বছর অন্য স্কুল থেকে ট্রান্সফার নিয়ে এই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কোনরকম ধর-পাকড়ের জোরে নয়, পঞ্চাশ ষাটজন বাইরের মেয়ের মধ্যে এখানকার অ্যাডমিশন টেস্টে সমস্ত পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে ভর্তি হয়েছিল। তারপর গেলবারের অ্যানুয়াল পরীক্ষায়ও ওই মেয়ে সমস্ত বিষয়ে ফার্স্ট হয়ে ক্লাস প্রমোশন পেয়েছে। কিন্তু পড়াশুনায় যত ভালই হোক ওই মেয়েই সমস্ত নষ্টের গোড়া। এসব অপকর্ম বেশীরভাগই তার। কাউকে পরোয়া করে না। ওই একটা মেয়েই বাকি চারটে মেয়েকে এভাবে নষ্ট করছে। ধরা পড়ার পর এই মেয়েরা ঘাবড়ে গিয়ে রেসিডেন্সিয়াল টিচারের কাছে সব কবুল করেছে। মেট্রন আরো জানালেন ধরা পড়ার পরেও ওই নন্দিতা বসুরই কেবল বেপরোয়া হাবভাব।
অভাবনীয় একটা শাস্তির নজির রাখার সংকল্প নিয়েছেন সুমিত্রা সিংহ। তার নামেই সমস্ত মেয়ের রক্ত জল, কোনদিন কোন মেয়ের গায়ে হাত তোলার দরকার হয়নি। কিন্তু এ ঘটনা সব কিছুর ব্যতিক্রম। তিনটে বেত আনিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন। তার নির্দেশমত রেসিডেন্সিয়াল টিচার আর মেট্রন ওই পাঁচ মেয়েকে ডেকে নিয়ে আসতে গেলেন।
শাস্তি কি দেবেন সুমিত্রা সিংহ সেটা স্থির করে ফেলেছেন। নতুন মেয়ে নন্দিতা বসু যত ভাল ছাত্রীই হোক এতখানি অধঃপতনের পর তাকে আর স্কুলে রাখবেন না। তাই তার গায়ে হাত তোলা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তাকে সেটা বুঝতে দেবেন না। তার সামনে চার মেয়েকে শাস্তি দেবার পর ব্যাড কন্ডাক্ট-এর ছাপ মেরে তাকে স্কুল থেকে তাড়াবেন।
পাঁচ মেয়েই এল। পিছনে রেসিডেন্সিয়াল টিচার আর মেট্রন। পুরনো চার মেয়ের বিবর্ণ পাংশু মুখ। এমনিতেই থর থর কাঁপছিল, প্রধান শিক্ষয়িত্রীর মূর্তি দেখে আর টেবিলের ওপর বেত দেখে তাদের আরো হয়ে গেছে। চারজনই হাত জোড় করে নিঃশব্দে ক্ষমা চাইছে।
ক্ষমাশূন্য চোখে একে একে সবকটি মেয়েকে দেখলেন সুমিত্রা সিংহ। সব শেষে নন্দিতা বসুকে। মেয়েটার তখনো উগ্র হিংস্র চাউনি। নতুন বয়সের খাঁচায় পোরা এক উদ্ধত জীব যেন। সংকল্প ভুলে সকলকে ছেড়ে ওকেই মাটিতে শুইয়ে ফেলার জন্যে হাত নিশপিশ করে উঠল সুমিত্রা সিংহর। কিন্তু নিজে তিনি সংযম খুইয়ে বসতে পারেন না।
ওই নন্দিতা বসু মেয়েটার দিকে কয়েক পলক চেয়ে থাকার পরই নিজের ভিতরে কেমন যেন একটা নাড়া-চাড়া পড়ল সুমিত্রা সিংহর। এই মেয়ের মুখে কার যেন চেনা আদল একটা। ঠিক মনে করে উঠতে পারছেন না, কিন্তু এই মুখে কার একখানা মুখ যেন হুবহু বসানো!
কয়েক নিমেষের অন্যমনস্কতা ঝেড়ে ফেলে সুমিত্রা সিংহ কর্তব্যে মন দিলেন। বেতের আঘাতে আঘাতে এক একটা মেয়ে আর্তনাদ করে মাটিতে লুটোপুটি খেতে লাগল আর তার পা জড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে লাগল। তখনো নির্মম কঠিন তিনি। শাস্তির পর একটি করে মেয়েকে বিদায় দিয়ে পরেরটিকে ধরেন। ঘরের মধ্যে শুধুই একটা ত্রাসের হাওয়া বইছে।
কিন্তু একটা করে মেয়ের ওই আর্তনাদের মুখেই এক একবার নন্দিতা বসুর দিকে চোখ গেছে তার। উদ্ধত আক্রোশে মেয়েটা যেন ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু বন্ধ দরজার সামনে মেট্রন দাঁড়িয়ে, বাইরে দরোয়ান। এক একটা মেয়ের শাস্তি শেষ হলে তবে দরজা খুলে তাকে বার করে দেওয়া হচ্ছে। তখনো সুমিত্রা সিংহর মনে হয়েছে রাগ হলে কার একখানা মুখের চিবুক আর ঠোঁট ওই মেয়েটার মতই বেঁকে যেতে দেখেছেন কবে। আবারও মনে হয়েছে মেয়েটার অমন সুশ্রী মুখের সঙ্গে কার যেন আশ্চর্যরকম মিল।
চার নম্বর পুরনো মেয়েও বেত্রাঘাতে জর্জরিত হয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ঘর ছেড়ে চলে গেল। সুমিত্রা সিংহ হাঁপাচ্ছেন বেশ। দুচোখ জ্বলছে। নিজের চেয়ারে বসে সোজা একবার তাকালেন নন্দিতা বসুর দিকে। সব থেকে বেশি দাগী মেয়েটা এখন বেপরোয়া উদ্ধত চোখেই চেয়ে আছে তার দিকে।