.
বিস্ময় কাটতে দুচোখের নীরব ভর্ৎসনাটুকুই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। পরে স্ত্রীর নরম সুরের জবাবদিহিতেও কাজ হল না তেমন। কিন্তু বাইরের আচরণে বরাবর সংযত মানুষ গৌরীনাথবাবু। মৃদু গম্ভীর স্বরে আদেশ দিলেন, ও-দুটো জায়গা-মত রাখো
উঠলেন। খোলা আলমারি থেকে চেক-বই বার করলেন। পকেট থেকে কলম টেনে নিয়ে সামনের ছোট টেবিলটায় বসলেন। খসখস করে চার হাজার টাকার চেক লিখে নাম সই করে চেকটা ছিঁড়ে ছোট ভাইয়ের হাতে দিলেন।–কাল ফার্স্ট আওয়ারে চার হাজার টাকা তুলে এয়ারে চার জনের সীট বুক করবি, টিকিট থাক বা না থাক আমার সেই অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার বন্ধুর কাছে গেলেই সে ব্যবস্থা করে দেবে। টিকিট হাতে পেলেই দিল্লীতে দীপুকে একটা আরজেন্ট টেলিগ্রাম করে দিবি। তারপর ছেলে আর তোর বউদিকে নিয়ে সন্ধ্যার ফ্লাইটে তুই আর দিবা দিল্লী যাবি–সাধ যখন হয়েছে টাকার জন্যে আটকাবে না।
সুপ্রীতি দেবীর শুকনো মুখ, বা রে, তুমি না গেলে কি করে হবে!
–আমার কথা-বার্তা যখন পছন্দ হচ্ছে না, নিজেই চেষ্টা করে দেখো।
গম্ভীর মুখে ঘর ছেড়ে ছেলের কাছে চলে গেলেন গৌরীনাথবাবু। ছেলে বারান্দায় হুইলচেয়ারে বসে।
রাতে মানভঞ্জনের পালা। রাগত মুখেই সুপ্রীতি দেবী বললেন, নিজের ওপর ভরসা করে কবে আমি কোন কাজ করি বা কোন কথা বলি তুমি জানো না?
বলতে না বলতে চোখে জল। একমাত্র এই বস্তুটিকেই গৌরীনাথবাবু মনে মনে ভয় করেন। ফলে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আপোস।
না, স্ত্রী আদৌ অতিশয়োক্তি করেননি। সর্ব ব্যাপারে সর্ব কাজে উনি স্বভাবগত কারণেই স্বামীর ওপর একান্ত নির্ভরশীলা। ঠিক এই জন্যে গৌরীনাথবাবুর কখনো খেদ কখনো অন্তর্ভুষ্টি। স্বামীর মতামত না পেলে কোনো একটা জরুরী ব্যাপারও স্ত্রীটি ফয়সালা করে উঠতে পারেন না। ভদ্রলোকের একবার শক্ত অসুখ হয়ে পড়তে একটা দুশ্চিন্তায় তার দুচোখে জল দেখা দিত।…তার অবর্তমানে হাজার টাকা পয়সা থাকলেও ওই স্ত্রীর অসহায় অবস্থাটা তিনি যেন দেখতে পেতেন। পরে কত সময় ধমকেছেন, একে একে নিজে সব দেখে শুনে বুঝে নাও,কখন কি দরকার হয় ঠিক আছে। কিন্তু তার তাগিদে দেখে-শুনে বুঝে নিতে গিয়ে স্ত্রীর হিমসিম অবস্থা। শেষে গৌরীনাথবাবু নিজেই হাল ছেড়ে তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
ছেলে স্ত্রী আর একটি ভাই নিয়ে গৌরীনাথবাবু দিল্লী উড়ে এসেছেন। কিন্তু তারপরেই যেন হাবুডুবু অবস্থা সকলের।
মহাযোগী বাবাকে নিয়ে দিল্লীতে এক এলাহি ব্যাপার। বিরাট পার্ক-এ তাবু ফেলে সাজিয়ে গুছিয়ে পঞ্চাশ হাজারের মতো জন-সমাবেশের ব্যবস্থা। কিন্তু আরো বিশ তিরিশ হাজারের বেশি ব্যবস্থা হলেও যথেষ্ট নয়। লোকে লোকারণ্য। সমস্ত দিল্লীবাসী বোধহয় ওই একপথে ভেঙে পড়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে কত রোগী এসেছে। ঠিক নেই। বাবার অবস্থানের দুমাইলের মধ্যে মোটর গাড়ি পার্ক করার পর্যন্ত জায়গা। মেলে না।…প্যাণ্ডেলে সকাল-সন্ধ্যার কীর্তনের আসরে বাবা একঘণ্টা দেড় ঘণ্টার জন্যে আসেন, ঘুরে ঘুরে সকলের উদ্দেশে আশীর্বাদ করেন হাত তুলে, ওই বিভোর তন্ময় মূর্তি দেখলেই মনে হয় এ-জগতের কেউ নন। রোগীদের মধ্যেও ঘোরাঘুরি করেন, হঠাৎ হঠাৎ কাউকে বিভূতিও দেন, কারো মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন। কিন্তু গড় হিসেবে সে-রকম ভাগ্য দুশর মধ্যে একজনেরও হয় কিনা সন্দেহ। বহু ক্লেশে গৌরীনাথবাবু দুবেলাই সপরিবারে বাবার দর্শন পাচ্ছেন–কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা বা কৃপা লাভ করা দুরাশাই বোধহয়। অথচ এই মুহূর্তে গৌরীনাথবাবুরও বদ্ধ বিশ্বাস, কৃপা পেলে উদ্দেশ্য সফল হবেই, অলৌকিক উপায়ে ছেলে ভালো হবেই।
কিন্তু সেই একান্ত সন্নিধানে কি করে যাবেন? পার্কসংলগ্ন যে বিশাল প্রাসাদে তিনি অবস্থান করছেন, তার চতুর্দিকেও জনসমুদ্র। দুর্ভেদ্য পুলিশ প্রহরায় আর ভলান্টিয়ারদের তৎপরতায় বাড়ির গেটের বিশ গজের মধ্যেও কারো যাবার উপায় নেই। অবশ্য বিশেষ ব্যবস্থা করে অনেকেই ভিতরে যাচ্ছেন, বাবার অনুগ্রহ পাচ্ছেন, কিন্তু সেই বিশেষ ব্যবস্থা গৌরীনাথবাবুর অন্তত করায়ত্ত নয়। কলকাতার ভক্তদের সঙ্গেও দেখা হয়েছে, কিন্তু অবস্থা এমন যে তারা নিজেরাই বাবার ধারে কাছে যেতে পারছেন না। এখানে কে কাকে চেনে?
নিরুপায়, সুপ্রীতি দেবী রাতে চোখের জলে বালিশ ভেজান আর প্রার্থনা করেন, বাবা, তুমিই ব্যবস্থা করো, পথ দেখাও।
বাবা দিল্লীতে অবস্থান করবেন সাতদিন। তার মধ্যে চার-চারটে দিন চলে গেছে। গৌরীনাথবাবু মরীয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের কাগজের এখানকার শাখা-অফিসের মারফৎ সকল চেষ্টাও ব্যর্থ হতে চলেছে।
এরই মধ্যে হঠাৎ আশার আলো এক টুকরো। অপ্রত্যাশিত যোগাযোগ একজনের সঙ্গে। অবাঙালী। প্রভাব প্রতিপত্তিশালী মন্ত্রী ছিলেন একসময় রাজধানীর। অধ্যাত্মবিদ হিসেবে সুপরিচিত তিনি। বহু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এবং সাধু-সন্তদের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ তার। তিনি রাজধানীতেই আছেন এবং গৌরীনাথবাবুর কাছে তিনি একেবারে দুর্লভ নন।
ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে তার কাছেই ধরনা দিয়ে পড়লেন গৌরীনাথবাবু। খবর পেয়েছেন, বাবার সঙ্গে ভদ্রলোকের এই দিনই বিকেলে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হয়ে আছে।