ঘরে আর যারা ছিল তারা চুপ। গৌরীনাথবাবুর চোখেমুখে ভর্ৎসনা মেশানো। বিস্ময়। সুপ্রীতি দেবীর আত্মস্থ হবার পক্ষে সেটুকুই যথেষ্ট। আবেগের মুখে কাজটা যে ভালো করা হল না সেটা তক্ষুনি মনে ডাক দিল। কারণ সর্ব ব্যাপারে স্বামীর মুখাপেক্ষী তিনি। নিজের বুদ্ধি বিবেচনার ওপর নির্ভর করে কোনো গুরু দায়িত্বের কাজই ঠিক মতো করে উঠতে পারেন না। গলার সুর নরম করে তক্ষনি ভুলটা শুধরে নিতে চেষ্টা করে বললেন, সর্বদা অত টাকা কারই বা হাতে থাকে, কাজ চালিয়ে নাও পরে না-হয় এর ডবল বানিয়ে দেবে।
কথাটা উঠেছিল ছেলের বিশেষ একটা দৈব আনুকূল্য লাভের প্রবল সম্ভাবনার প্রসঙ্গে। বারো বছরের একমাত্র ছেলে দুরারোগ্য ব্যাধি-কবলিত। এখন একেবারে উত্থানশক্তিরহিত পঙ্গু। ভবিষ্যতের অবধারিত চিত্র আরো ভয়াবহ অন্ধকার। পৃথিবীর সমস্ত চিকিৎসাই ব্যর্থ। তারপর ভারতের বহু তীর্থে বহু দৈব-প্রচেষ্টা, যাগযজ্ঞ ক্রিয়াকলাপ আর দামী-দামী স্টোন ধারণের ফাঁক দিয়েও কত হাজার টাকা জলের মতো বেরিয়ে গেছে, হিসেব নেই। এখন শুধু হতাশা আর হতাশা।
এই সময় এক মহাসাধকের নাম প্রায়ই কানে আসতে লাগল তাদের। কলকাতার দোকানে দোকানে তার ছবি দেখা যেতে লাগল। আর বহু নাম-করা কাগজেও ভগবান-সদৃশ ওই মহাযোগীর এমন সব করুণা-লীলার কাহিনী প্রচার লাভ করল যে পড়লে শুচিশুভ্র আবেগে চোখে জল আসে।
গৌরীনাথবাবু খুব একটা বিশ্বাস করেননি। কিন্তু মন দুর্বল। স্ত্রীর মন ততোধিক দুর্বল। ফলে ওই করুণাময় সম্পর্কে দিশি আর বিদেশী লেখকের বই সংগ্রহ করে দুজনেই পড়তে লাগলেন। সেইসব বাস্তব অভিজ্ঞতার কাহিনী এবং তত্ত্ববিশ্লেষণ অভিভূত হবার মতোই বটে। এ ছাড়া বহু শুভার্থীজনও তাদের। পরামর্শ দিলেন, একবার কপাল ঠুকে চলে যান ছেলেকে নিয়ে, যদি দর্শন মেলে আর দয়া মেলে তাহলে অলৌকিক কিছু হতেও পারে, এমনিতে তো আর কোন আশা নেই।
কিন্তু চলে যান বললেই এই ছেলে নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায় না। অলৌকিক বিভূতিসম্পন্ন ওই মহাতপা যেখানে থাকেন ছেলের বর্তমান অবস্থায় সেদিকে পা বাড়ানোটা দুর্গমযাত্রার সামিল। বইয়ে সে-পথের বিবরণ শুনে সুপ্রীতি দেবী পর্যন্ত। দমে যান। ফলে, মনে মনে প্রায় অলৌকিক গোছের একটা আশা নিয়ে বসে ছিলেন। তিনি। খোঁজ-খবর করে এই কলকাতায়ও ওই দেব-মানবের অনেক গণ্যমান্য ভক্তের সন্ধান পেয়েছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। শুনেছেন বাবাকে একবার তারা এই কলকাতায় নিয়ে আসতে চেষ্টা করছেন। তবে এও শুনেছেন, বাবার ইচ্ছে না হলে শত চেষ্টাতেও তা হবে না।
গৌরীনাথবাবু স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছেন, ইচ্ছে হবেই একদিন। ভক্ত টানলে ভগবানেরও টনক নড়ে। স্বামীর ওপর আর তার কথার ওপর স্ত্রীটির অগাধ আস্থা। কিন্তু আরো প্রায় দেড়টা বছর কেটে যেতে তিনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। ছেলের অবস্থা ধীর কিন্তু অবধারিত গতিতেই সঙ্কটের দিকে গড়াচ্ছে।
এমন দিনে একটা সংবাদ শুনে সুপ্রীতি দেবী আশায় আনন্দে কন্টকিত।ঐশ্বরিক ক্ষমতার ওই মহাযোগী দিল্লীতে আসছেন। সেখানকার ভক্তরা তার সম্মতি পেয়ে বিপুল আয়োজন করেছেন। পাকা খবর। দিন তারিখ পর্যন্ত নির্দিষ্ট। কলকাতার বহু ভক্ত দিল্লীর দিকে ছুটেছেন।
দিল্লী! সুপ্রীতি দেবীর মনে হল দিল্লী একেবারে হাতের মুঠোয়। এরোপ্লেনে দুঘণ্টার পথ। পা ফেলার পর আর কোনো ঝামেলা নেই, সেখানে দেওরের বাড়ি দেওরের গাড়ি। ঠাকুর মুখ তুলে না চাইলে এমন সুযোগ আসে!
শোনার পর মন দুর্বল গৌরীনাথবাবুরও। কিন্তু তাকে সাত-পাঁচ ভেবে দেখতে হবে। অন্ধ অবাস্তব আশার পিছনে ছুটে এযাবত বহু হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। কম করে পঞ্চাশ ষাট হাজার তার ওপর এক-একটা চেষ্টা বিফল হবার পর সে কি হতাশা–বিশেষ করে স্ত্রীর। ভেঙে পড়ার দাখিল একেবারে।
অতএব সবদিক ভেবে দেখারই আলোচনায় বসা হয়েছিল সকলে মিলে। কিন্তু দ্বিধার প্রথম পর্যায়েই সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী জিজ্ঞাসা করে বসলেন, আসল কথা, বাবার সঙ্গে দেখা হলে আর তার করুণা পেলে ছেলে ভালো হয়ে যাবে, এ তুমি বিশ্বাস করো কি করো না?
গৌরীনাথবাবুর বিব্রত মুখ। বইপত্র যা পড়েছেন, মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেই মন চায়। দ্বিধান্বিত জবাব দিলেন, করুণা পাবই এমন ভরসা কোথায়?
স্ত্রী স্থির প্রত্যয়ে জবাব দিলেন, দেখা পেলে করুণাও পাব।
–সেভাবে দেখা মিলবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সুপ্রীতি আধা বিস্মিত আধা বিরক্ত।কি যে বলো ঠিক নেই, দিল্লীর মতো জায়গায় তুমি নিজে চেষ্টা করলে দেখা হবে না এ আবার একটা কথা নাকি! তাছাড়া এখান থেকে চেনা-জানা ভক্ত যাঁরা যাচ্ছেন তারাও সাহায্য করবেন। তারও দরকার হবে না, তুমি চেষ্টা করলেই হবে–
মনে মনে বিরক্ত একটু গৌরীনাথবাবুও। স্ত্রীর ধারণা, তার স্বামী নাম লেখক। আর কাগজের বড় চাকুরে অতএব দুনিয়ার সমস্ত দরজাই তার কাছে খোলা। বললেন, হ্যাঁ, আমি দিল্লীর লাটসাহেব একেবারে। যাক, এরপর খরচের দিকটাও চিন্তা করার আছে, ওই ছেলেকে নিয়ে যেতে হলে তুমি আমি ছাড়াও আর একজন লোক অন্তত দরকার–এরোপ্লেনে চারজনের যাতায়াত ছাড়াও অন্য খরচা আছে, কম করে চার হাজার টাকা লাগবে।
জবাবে চিরসহিষ্ণু আর চিরমুখাপেক্ষী স্ত্রীর ওই কাণ্ড। সকলের সামনে আলমারি থেকে গয়নার বাক্স বার করে ওই উক্তি।