কিন্তু রুমাবাঈ তবু গেল না। নিশ্চল মূর্তির মত আরো খানিকক্ষণ বসেই রইল। তারপর তেমনি নম্র অথচ দ্বিধাশূন্য স্পষ্ট গলায় বলল, মালিক কেন আমাকে তাড়াচ্ছেন, আমি তা জানি। ওদের হিংসা আমিও দেখছি। রটনা যে একটুও সত্যি নয়, আমি যদি তার প্রমাণ দিতে পারি, তাহলেও কি মালিক আমাকে রাখতে আপত্তি করবেন?
ওই কথা কটি, কণ্ঠস্বর, আর আচরণের মধ্যেও কিছু বোধহয় ছিল। কাকাজী বোবার মত দাঁড়িয়ে। আর মানিকলালও কৌতূহলে থমকালেন ঈষৎ।
–কি প্রমাণ দেবে?
প্রমাণ রুমাবাঈ মুখে কিছু দিল না। আস্তে আস্তে ঘন কালো বোরখাটা খুলে। ফেলল শুধু। খুলে সেটা সরিয়ে রাখল। তারপর মানিকলের দিকে দুচোখ মেলে তাকাল শুধু।
এতবড় বিস্ময় কাকাজী আর মানিকলের জীবনে এই প্রথম।
কাকে দেখছেন তারা কিছুই বুঝছেন না। রূপসাধক কোনো শিল্পীর আঁকা যেন–নাক-মুখ-চোখ–সমস্ত নারী-অঙ্গ। জ্যোৎস্নাঘোয়া ধপধপে গায়ের রঙ। শুধু হাতের খানিকটা আর পায়ের খানিকটা কালো রঙ করা–বোরখা পরা থাকলে যতটুকুর আভাস পাওয়া সম্ভব ততটুকু।
মানিকলাল আর কাকাজীর চোখে পলক পড়ে না, মুখে কথা সরে না।
রুমাবাঈ তেমনি শান্ত মুখে বলে গেল, যে সন্দেহ করে মালিক আমাকে তাড়াতে চাইছেন, তা সত্যি হলে টাকার জন্যে এ-পথে আসার দরকার হত না বোধহয়–মেহনতী কাজ করতে হত না। তা চাই না বলে হাতে-পায়ে কালো রঙ মেখে সকলের চোখ থেকে নিজেকে আড়ালে রেখে সম্মানের উপার্জনে লেগেছি।
দু-চার কথায় এরপর পিতৃসদৃশ মানিকলাল আর কাকাজীর কাছে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলেছে সে। এই রূপই তার জীবনের সবথেকে বড় অভিশাপ, দুষ্ট লোকে তার নামে কলঙ্ক দিয়ে তার স্বামী কেড়ে নিয়েছে–একটি ছেলে নিয়ে তাকে পথে দাঁড়াতে হয়েছে। সেই ছেলেটিই এখন প্রাণ তার। তাকে সে মানুষ করছে, ভালো জায়গায় রেখে পড়াচ্ছে। তাকে কোনো কলঙ্ক স্পর্শ করলে সেই ছেলে বড় হবে কি করে, মানুষ হবে কি করে? মালিক যেন দয়া করে কাজ থেকে না ছাড়ান তাকে, ছোট মালিক কোনোদিন তার মুখ দেখেন নি, কোনোদিন দেখবেনও না।
কাকাজীর কাছে কুঞ্জলাল এ-সব শুনেছে বাবার মৃত্যুরও অনেক পরে। শুনেছিল, কারণ কুঞ্জলালই একবার তাকে কাজ থেকে জবাব দেবে স্থির করেছিল। যে মেয়ের কাজে কখনো কোনো ত্রুটি দেখেনি, তারই কাজে পর পর অনেকদিন গাফিলতি দেখেছে। সময়ে কাজ নেয়নি, সময়ে কাজ দেয়নি, যাও দিয়েছে তাও মনোমত হয় নি। কুঞ্জলাল ভেবেছিল, রোজগারের দেমাকে এই অধঃপতন। তার ওপর একটা বড় কাজের জন্য দু তিনবার তার কাছে কর্মচারী পাঠাতে সে বলে পাঠিয়েছিল, এখন অসুবিধের মধ্যে আছে ভারি কাজ নেওয়া এ সময়ে তার পক্ষে সম্ভব নয়।
কুঞ্জলাল তেতে ছিল, এইবার আগুন হয়ে উঠল। তাছাড়া মেয়েটার চরিত্রের ওপর কটাক্ষ করার লোকও সর্বদাই আছে। কর্মচারীদের অনেকেই ঠাট্টা করেছে, নাগর। জুটেছে বোধহয়, এখন ভারি কাজ নিয়ে সময় নষ্ট করবে কেমন করে!
কুঞ্জলাল মেয়েটিকে জবাব দেবে স্থির করেছে শুনে কাকাজী তাকে নিরস্ত করতে চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, তার ছেলের খুব অসুখ–আমাকে সে জানিয়েছে।
কুঞ্জলাল সে-কথা কানে তোলেনি। আবার ছেলেও আছে শুনে মনে মনে উল্টে সে অশ্লীল কটুক্তি করেছে। ছেলে থাকলেও সুস্থ সামাজিক সন্তান ভাবেনি। আর ছেলের অসুখ, তাও বিশ্বাস করেনি। সে ব্যবসায়ী, ব্যবসা সব কিছুইর আগে অসুখের বিন্যাস শোনার আগ্রহ তার নেই।
এরপর রুমাবাঈ আবার একদিন কাজের জন্য আসতে সে জবাব পাঠাতে যাচ্ছিল, কাজ নেই। কিন্তু কাকাজী আবার বাধা দিয়েছেন। তাকে আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে সেই একদিনের ঘটনা বলেছেন। শুনে কুঞ্জলাল কতক্ষণ স্থাণুর মত বসেছিল, ঠিক নেই। ইতিমধ্যে কাকাজী রুমাবাঈকে পরদিন আড়তে এসে মালিকের সঙ্গে দেখা করে কাজ নিয়ে যেতে বলে দিয়েছেন।
রুমাবাঈ এসেছিল। কুঞ্জলাল প্রথমেই ছেলে কেমন আছে জিজ্ঞাসা করেছে। জবাব দেবার আগে রুমাবাঈ চুপ করে বসেছিল খানিক। ছেলের অসুখের খবরটা সে একমাত্র কাকাজীকেই গোপনে দিয়েছিল। অস্ফুট শান্ত জবাব দিয়েছে, মালিকের আশীর্বাদে ভালো আছে।
কুঞ্জলাল আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারেনি। চুপচাপ চেয়ে চেয়ে সেই কালো। বোরখা আর কালো হাত-পা দেখেছিল। তারপর নিঃশব্দে কাজ এগিয়ে দিয়েছে।
রুমাবাঈয়ের এই কালো বোরখা যেন স্পষ্ট নিষেধ। কিন্তু নিষেধ মানতে চায়নি কুঞ্জলাল। একদিন ওই বোরখা সরাবার জন্য অনুনয় করেছিল। কাকাজীর কাছে সব শুনেছে জানিয়ে একটিবার মাত্র তাকে দেখতে চেয়েছিল।
কিন্তু ঘন-কালো বোরখার আড়ালে নিষ্প্রাণ মূর্তির মতই বুঝি বসেছিল রুমাবাঈ। তারপর খুব নরম করে আস্তে আস্তে বলেছে, কথা দিয়ে সে কখনো কথার খেলাপ করেনি–বড় মালিককে সে কথা দিয়েছিল। ছোট মালিককে সে শ্রদ্ধা করে, তিনি যদি চান সে বোরখা সরাবে…কিন্তু তাহলে আর তার কোনোদিন এখানে কাজ নিতে আসা হবে না।
কুঞ্জলাল তা চায় নি।
মা
বাবা মা ভাই বোন ভাইয়ের স্ত্রী ভগ্নিপতি–সব মিলিয়ে একঘর লোকের সামনে স্ত্রীর এই বেখাপ্পা আচরণ দেখে গৌরীনাথবাবু আধা বিস্মিত আধা ক্রুদ্ধ। তার দুশ্চিন্তা আর দ্বিধার জবাবে স্ত্রী সুপ্রীতি উঠে দাঁড়িয়ে বিছানার তলা থেকে চাবির গোছা বার করে দেয়াল-ঘেঁষা গডরেজের আলমারিটা খুলে ফেললেন। তারপর অন্য চাবি দিয়ে ভিতরের লকারটা। লকার থেকে বড় বড় দুটো গয়নার বাক্স বার করে গৌরীনাথবাবুর সামনে রাখলেন। ঈষৎ অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, হাতে টাকা না থাকে তো এগুলো দিয়ে ব্যবস্থা করো–ছেলে ফিরে না পেলে কিসের টাকা কিসের গয়না