কারিগরদের কাছে কুঞ্জলাল মনিব কড়া দেখলাম। কাজ মনের মত না হলে রূঢ় কথা মুখে আটকায় না–তা সে মেয়ে হোক, বা পুরুষ হোক। তবে কাজের হাত যাদের ভালো, তাদের সে অবজ্ঞা করে বলে মনে হল না। কিন্তু অন্যেরা তটস্থ তার সামনে।
সেদিনও তার আড়তে এসে দেখি, বোরখা-পরা একটি মেয়ে বসে। আগেও দেখেছি, কিন্তু দেখার মত নয়। অর্থাৎ, হাত আর পা শ্যামবর্ণ। তবে বেশ স্বাস্থ্যবতী মনে হয়। মেয়েটি স্থির বসে আছে, আর কুঞ্জলাল তার সামনে ঝুঁকে বসে সাগ্রহে কতকগুলো অর্ডার বুঝিয়ে দিচ্ছে। রাজা-মহারাজার ঘরের অর্ডার, এর দায়দায়িত্ব এবং মুনাফা, সবই বেশি।
মেয়েটি মাঝে মাঝে সায় দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলছে, জী–।
অর্থাৎ, যা তাকে বোঝানো হচ্ছে, সে বুঝতে পারছে। কিন্তু ওইটুকু থেকেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর ভারি মিষ্টি মনে হল আমার। অর্ডারগুলো গুছিয়ে নিয়ে আমাদের দুজনের উদ্দেশ্যেই বিনীত অভিবাদন জানিয়ে মেয়েটি শান্ত পায়ে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
কোনো কারিগরের প্রতি কুঞ্জলালের এতটা সম্ভ্রমপূর্ণ মিষ্টি ব্যবহার আর দেখিনি। মেয়েটি চলে যাবার পরেও কুঞ্জলালকে বেশ অন্যমনস্ক দেখাল যেন। একটু বাদে আমাকে বলল, এই মেয়েটি আমার কারবারের সব থেকে সেরা কারিগর, মাস গেলে কম করে পাঁচ-ছশ টাকা রোজগার করে। সী ইজ এ স্কীল আর্টিস্ট।
এত ভালোর কদর হতেই পারে। কিন্তু কুঞ্জলালের হাব-ভাব আমার কেমন যেন। লাগল–এর সবটুকুই ব্যবসায়সুলভ মনে হচ্ছে না। প্রশংসাটুকু একটু যেন আবেগ মেশান। অথচ মেয়েটি তো চোখে পড়া বা মনে ধরার মত কিছু নয়। তার ওই হাত আর পায়ের আভাসের ওপর সাদাটে গোলাপী রঙ চড়ালে বরং চোখে অন্য রকম লাগতে পারত।
কি মনে হতে কুঞ্জলাল নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। সাগ্রহে বলল, তুই তো লেখক বনে গেছিস–একটা গল্প শুনবি? এ লাইফ?
আমি শঙ্কা বোধ করলাম। কুঞ্জলাল বিয়ে করেছে, ছেলেপুলের বাপ, বয়েস চল্লিশ পেরিয়ে গেছে–কিন্তু য়ুনিভার্সিটির সেই রোগ এখনও আছে নাকি!
কুঞ্জলাল আমার মুখের দিকে চেয়েই মনের কথাটা বুঝল বোধহয়। বলল, তুমি যা ভাবছ বন্ধু, তা নয়–মেয়েটিকে আমি আজ পর্যন্ত চোখেও দেখিনি।
কুঞ্জলাল গল্প শুনিয়েছে। গল্পটা ভোলা সম্ভব নয়। শোনার পর মনে হয়েছে, না শুনলে লক্ষ্ণৌ আসা আমার ব্যর্থ হত।
বাপ বেঁচে থাকতেই কুঞ্জলাল কারবারের সমস্ত ভার নিজে নিয়েছিল। বাপ মানিকলাল প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। কুঞ্জলাল আর ওই কাকাজীকে কারবার দেখতে হত। কুঞ্জলালের আমলে কারবারের অনেক উন্নতিও হয়েছে। সেই সময় ওই মেয়েটি কিছুদিন হয় কাজে লেগেছে। নাম রুমাবাঈ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হাতের কাজ, কথামত কাজ দিয়ে যায়–একটা দিনের জন্যেও কথার খেলাপ করে না। কুঞ্জলালের তখন কারবার ফাঁপানোর নেশা, যে ভালো কাজ করবে, যার কাজ দেখে ক্রেতা মুগ্ধ হবে, তাকে দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিতে, বা দ্বিগুণ কাজ দিতে তার আপত্তি নেই। দেখতে দেখতে রুমাবাঈয়ের রোজগার সকলকে ছাড়িয়ে গেল। সব থেকে সেরা অর্ডার নেবার জন্য তারই ডাক পড়ে।
অন্যান্য কারিগররা ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল ক্রমশ। তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে লাগল একটু একটু করে। একটু আধটু রটনা শোনা যেতে লাগল। ব্যাপারটা কাকাজীর চোখেও ঘোরালো ঠেকল কেমন। মেয়েটি রূপসী মনে হলে আগেই সন্দেহ হত তাঁর, আগেই উতলা হতেন। কিন্তু রটনা কানে আসতে আর স্থির থাকতে পারলেন না তিনি। ভাইপোর কলকাতার কাণ্ডকারখানা ভালোই জানেন। রূপ থাক আর না থাক, কে কোথায় মজে ঠিক কি! মেয়েটির হাতের কাজ ভালো তিনিও স্বীকার করেন, কিন্তু বিপদের সম্ভাবনাটাই আরো বড় করে দেখলেন তিনি। শুধু কাজ ভালো হলেই এত কদর হয় না–ভালো কাজ করে এমন বয়স্ক অভিজ্ঞ কারিগরও তো আছে!
ব্যাপারটা অগ্রজ, অর্থাৎ মানিকলালকে জানানো কর্তব্য বোধ করলেন তিনি। জানালেন। শুনেই মানিকলাল ত্রাসে অস্থির। ছেলের বিয়ে-থা দিয়ে তার নতুন বয়সের রোগটার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি। সেইদিনই রুমাবাঈকে আড়তে ডেকে পাঠালেন। শুধু কাকাজী আছেন তার সঙ্গে, আর কেউ না।
রুমাবাঈ এল। হিসেব-পত্র করাই ছিল। মানিকলাল তার পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দিলেন। বললেন, তোমাকে আর প্রয়োজন নেই, আর এস না।
রুমাবাঈ স্থির পাথরের মত বসে রইল কিছুক্ষণ। মুখ না দেখা গেলেও মুখের অবস্থা অনুমান করা কঠিন নয়। তারপর আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করল, মালিক কি আমার কাজে কোনো গাফিলতি পেয়েছেন?
মানিকলাল বললেন, না, আমার আর দরকার নেই।
নরম অথচ স্পষ্ট করে রুমাবাঈ বলল, কিন্তু আমার যে বড় দরকার মালিক। হঠাৎ এভাবে কাজ বন্ধ করে দিলে বড় অসুবিধেয় পড়ব-মালিক দয়া করে আর কটা দিন সময় দিলে
মানিকলালের মেজাজ চড়েছে। সাফ জবাব দিলেন, আর একদিনও না, অন্য জায়গায় কাজ দেখে নাও গে যাও।
কিন্তু রুমাবাঈ উঠল না। তেমনি সবিনয়ে বলল, মালিক যে কারণে আমাকে তাড়াতে চাইছেন সেটা একেবারে মিথ্যে। ছোট মালিক কাজ বোঝেন, কাজের সমঝদার তিনি, কাজ দেখে খুশী হয়েছিলেন বলে আমার নসীব ফিরেছিল। তিনি শুধু কাজই দেখেছেন, আমাকে কখনও দেখেন নি।
শোনামাত্র মাথায় রক্ত চড়েছিল মানিকলের। তিনি চেঁচিয়ে উঠেছেন, কি সত্য আর কি মিথ্যে, কে তোমার কাছে শুনতে চেয়েছে? ছোট মালিক কি দেখেছে না দেখেছে কে তোমার কাছে জানতে চেয়েছে? ছোট মালিকের নাম কে তোমাকে তুলতে বলেছে এখানে? তোমাকে আমার দরকার নেই, তুমি চলে যাও, ব্যস।