নবাবের দেশ, ইতিহাসের দেশ, বিপর্যয়ের দেশে এসে আমি শুধু লেখার রসদ খুঁজে বেড়িয়েছি। আমি যাঁর আশ্রিত তিনি এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা। ভদ্রলোক ডাক্তার। সুরসিক। সাইকেল রিক্স আর টাঙ্গায় আপদমস্তক কালো বোরখা-ঢাকা মহিলাদের প্রতি আমার একটু বিশেষ লক্ষ্য দেখে তিনি অনেকরকম ঠাট্টা-ইশারা করেছেন। এমন কি কলকাতায় আমার গৃহিণীকে সাবধান করবেন বলেও শাসিয়েছেন।
কিন্তু সত্যিই আমার রহস্যের মত লাগত। বোরখা-ঢাকা প্রায় মুখগুলোই দেখতে ইচ্ছে করত। বোরখা জিনিসটার উৎপত্তি-ব্যুৎপত্তির খবর জানি না। এককালে ওটা হয়ত নিষেধেরই নিদর্শন ছিল। কখনো-সখনো পুরুষ-সন্নিধানে আসতে হলে চোখের আঁচ ঠেকাবার উপকরণ ছিল হয়ত ওটা। কিন্তু এখন অন্তঃপুরিকাদের পুরুষের সমান তালে পথে বেরনো নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই ওটা আর এখন নিষেধের বস্তু মনে হয় না, অঙ্গসজ্জা বলেই মনে হয়। সহজ সান্নিধ্যেও নিজেকে আড়ালে রেখে পুরুষ-চেতনা সচেতুন রাখার মত লোভনীয় অঙ্গ-সজ্জা। যা দেখলে কৌতূহল জাগে, কল্পনার জাল বুনতে ইচ্ছে করে।
সামনে দিয়ে সেদিন ঝকঝকে একটা প্রাইভেট টাঙ্গায় দুজন বোরখা-ঢাকা মহিলা যাচ্ছিলেন। এক নজর তাকালেই অভিজাত মনে হয়। আমি কত নজর তাকিয়েছিলাম বলতে পারব না। টাঙ্গা দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের এই বোরখা-পরা মেয়েরা প্রায় সবাই কি অপরূপ সুন্দরী?
সঙ্গী জবাব দিলেন, সুন্দরী অনেক আছে, কিন্তু প্রায় সবাই কেন হবে? কেন বলুন তো?
–আমার তো প্রায় সকলকেই ভারি সুন্দরী বলে মনে হয়। হাতের আর পায়ের যতটুকু দেখা যায় ফুটফুট করছে
সঙ্গী ঠাট্টা করলেন, সকলকেই যেন চাদে ধোয়া, কেমন?
–তাই তো। দেখতে ইচ্ছে করে…।
–আচ্ছা, আপনাকে চেষ্টা করব দু-চারটে দেখাতে। তারপর আর দেখতে ইচ্ছে। করবে না–এতদিন ধরে এখানে ডাক্তারী করছি, দু-চারটে ছেড়ে দু-চারশ দেখেছি বোধহয়। প্রথম প্রথম ওই হাত দেখে আর পা দেখে আপনার মতই খুব দেখতে ইচ্ছে করত। মাথা ধরার ওষুধ নিতে এলেও, চোখ দেখা আর জিভ দেখার নাম করে কম দেখতাম না। এখন আর একটুও দেখতে ইচ্ছে করে না।
আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে হল না, বিস্ময় লক্ষ্য করেই ভদ্রলোক হা-হা করে হেসে উঠলেন।–আরে মশাই, এটা রঙের যুগ, ভুলে যান কেন? মনে রঙ এলে বাজারের রঙ ঘরে আসতে কতক্ষণ! কত সুবিধে বলুন তো, শুধু হাত দুখানা আর পা দুখানা রঙ-পালিশ করে নিলেই হল। আর নিখুঁতভাবে করতেও পারে এরা, হাত দেখলে মনে হবে চাপার কলি, পা দেখে ভাববেন চরণকৌমুদী।
ছন্দপতন। ডাক্তার হলেই কি এমন বেরসিক হতে হয়। আমার সৌন্দর্য কল্পনার। জালটা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। এই জাল নিয়ে এরপর কোনো সত্যিকারের সুন্দরীকেও ঘেঁকে তোলা শক্ত।
এবারে কুঞ্জর কথা বলি। অর্থাৎ কুঞ্জলালের কথা। গৃহিণীর জন্য একখানা চিকন শাড়ি নিয়ে যাব বলে এক মস্ত দোকানে ঢুকে পড়েছি। মাঝে বিশটা বছরের ব্যবধান–লক্ষ্ণৌয়ে এসেছি, চিকন শাড়ি কিনব বলে এসেছি–তখনো কুঞ্জলালের কথা একটি বার মনেও পড়েনি। সামনের গদির বৃদ্ধটি পরম সৌজন্যে আহবান জানালেন, আইয়ে–
ভিতরের মস্ত ফরাসে বড় কাঠের ক্যাশ-বার সামনে বসে যে লোকটি, সেও সবিনয় আপ্যায়ন জানাতে গিয়ে মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ থমকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও। দুজনের এই থমকানি থেকেই সংশয় দূর হয়ে গেল। কুঞ্জলাল ক্যাশ-বাক্স টপকে দুহাতে আমাকে জাপটে ধরে দু-চার ঝকানির পরেই এমন একটা কাণ্ড করে বসল, যা দেখে দোকানের কর্মচারীরা আর অন্যান্য ক্রেতারা হাঁ। আমার শরীরের ভারও নেহাত কম নয়, ফলে আমাকে নিয়ে ফরাসের উপরেই একপ্রস্থ গড়াগড়ি। পরে দম নিতে নিতে বলল, তুই একটা ইডিয়ট, তুই একটা রাবিশ, কতকাল পরে দেখলাম রে তোকে! তুই একটা জেম! পাকাঁপোক্ত লেখক বনে গেছিস একেবারে-অ্য? ..চোখ পাকাল, তোর বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখলেই আমি কিনে ফেলি সে-খবর রাখিস? থাকিস কোন চুলোয়? প্রথম বই পড়ে দশ বছর আগে একটা চিঠি লিখেছিলাম –নো রিপ্লাই। উঃ, তোকে এখন খুন করতে ইচ্ছে করছে আমার
সকলের অগোচরে তার হাতের কাছ থেকে একটু সরে বসে হাসতে লাগলাম। কর্মচারীরা বা ক্রেতারা বাংলা না বুঝলেও উচ্ছ্বাস বুঝল। সামনের বৃদ্ধটি ঘাড় ফিরিয়ে দেখছেন আর হাসছেন মিটিমিটি। কুঞ্জলালের বাবা মানিকলাল নন, তাকে আমি কলকাতায় দেখেছি।
আজকের মত কুঞ্জলালের দোকানে বসা হয়ে গেল–আমার চিকন শাড়ি কেনাও। আমাকে নিয়ে উঠে পড়ল। বৃদ্ধটিকে বলল, কাকাজী, আমার পুরনো বন্ধু এসেছে। –একসঙ্গে দশ বছর পড়েছি আমরা–আমি এখন দোকানে থাকছি না।
তারপর কয়েকটা দিন কুঞ্জলালের সঙ্গেই বেশির ভাগ সময় কেটেছে। কুঞ্জলাল বিয়ে-থা করেছে, ছেলেপুলে আছে। না, বাঙালী মেয়ে নয়, স্বজাতিকেই বিয়ে করেছে। তার বাবা বছর তিন-চার হল মারা গেছেন। এতবড় কারবারের সে-ই মালিক এখন।
এই সাক্ষাতের ফলে আমার কলকাতায় ফেরাই দিন কতক পিছিয়ে গেল। সকালের দিকে তার আড়তে বসে কথাবার্তা গল্প-গুজব হয়। মস্ত আড়ত। চিকনের কারিগররা সব এখানেই আসে। পারিশ্রমিক নেয়, অর্ডার-পত্র নেয়। মেয়ে-পুরুষ দুই রকমের কারিগরই আছে। এর মধ্যে বর্ষীয়সী কয়েকটি রমণীর বোরখার সামনের দিকটা। ঘোমটার মত করে তোলা। অল্পবয়স্কা আপাদ-মস্তক বোরখা-ঢাকা কয়েকটি মেয়েকেও দেখলাম। কারো হাত-পা তেমনি ফুটফুটে ফর্সা। কিন্তু ডাক্তার বন্ধু আমার রূপাভিসার কল্পনার ঝোঁকটা বিধ্বস্ত করে দিয়েছেন। এদের হাত-পায়ের দিকে চেয়ে আমি এখন উল্টে আসল রঙ আবিষ্কার করতে চেষ্টা করি।