আমি দেখছি। মহিলাকে ঘিরে লোকের সংখ্যা এখন কম করে তিরিশজন। নানা বয়সের লোক। চেনা মুখও আছে এর মধ্যে অনেক। মহিলার দিকে তাকালাম আমি। কান্না থামেনি তখনো। তার হাতে প্রেসকৃপশনটা আছে শুধু।…এক কালে সুন্দরীই ছিল মনে হয়। অনটনের হাড়কাঠে পড়ে সে-সৌন্দর্য গেছে বোঝা যায়। কাঁদছে আর অসহায় চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে। শোকে আর উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। ঈষৎ স্রস্ত বসনের ওধারে ওই বুকের ওঠা-নামা দেখছে কেউ কেউ। কেউ পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। কেউ বা জেরা করে করে ছিনতাইয়ের আরো সঠিক হদিশ পেতে চেষ্টা করছে।
আমি দেখছি একটা শোক আর হতাশা যেন মহিলার দুচোখ দিয়ে ঠেলে বেরুচ্ছে। ঘরে রুগ্ন স্বামী নিশ্চয় তার প্রতীক্ষায় বসে আছে। কিন্তু সে ঘরে যাবে কোন মুখ নিয়ে?
এ পাড়ায় এ রকম হামলা সন্ধ্যায় বা রাতে আরো হয়ে গেছে। এখন দিন মানেও এই উপদ্রব শুরু হয়েছে। লোকচরিত্র বা পথচিত্র দেখে যদি কোন অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে তাহলে আমার ধারণা মহিলার এত বড় ক্ষতিটা পূরণ করে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কোন একজনের প্রথম এগিয়ে আসা দরকার।
পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম দুটো দশ টাকার নোট আছে। কয়েক মুহূর্তের দ্বিধা কাটিয়ে আমিই এগিয়ে গেলাম। গোল হয়ে যারা ঘিরে আছে মহিলাকে এবং নানা দিক থেকে নানাভাবে দেখছে, তাদের সক্কলকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ছিনতাই ঠেকাতে পারছি না, দিনে দুপুরে এই কাণ্ড–এ আমাদের দোষ, আমাদের পাড়ার দুর্নাম। এই আমি কুড়িটাকা দিলাম, আপনারা যে যা পারেন দিয়ে মহিলাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করুন।
নিন ধরুন।
মহিলা থমকে তাকাল আমার দিকে। দুগালে তখনো জলের দাগ। কি করবে ভেবে পেল না।
ধরুন, ধরুন। এটা লজ্জা করার সময় নয়–দোষ আপনার নয়, দোষ আমাদের। নোট দুটো হাতে গুঁজেই দিলাম একরকম।
আর একজন দেখলাম পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করছে।
নায়কের ভূমিকা নেবার পর আর দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। এক-আধজন আবার অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে আমাকে।
কিন্তু বেশিরভাগ লোকেরই পকেটে হাত ঢুকছে দেখলাম। পথচিত্র দেখে অভ্যস্ত এই দুটো চোখ আগেই আঁচ করেছিল এ রকম হবে।
সরে এসে পানের দোকানের সামনে সবে দাঁড়িয়েছি। বছর চল্লিশ বিয়াল্লিশের। একটি লোক সেখানে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে আর হুস হুস করে সিগারেট টানছে। আমাকে দেখেই একটা চোখ ছোট করে আর সেই রকমই হেসে পরিচিতের মতই। জিজ্ঞাসা করল, কি মশাই, টাকা দিয়ে এলেন নাকি?
সঠিক না বুঝে আমি বললাম, হ্যাঁ।
লোকটা ফিক ফিক করে আরো বেশি হাসতে লাগল আর সেই সঙ্গে জোরে দুতিনটে টান মারল সিগারেটে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞাসা করল, কেন দিলেন, সুন্দর মুখের বিলাপটুকু পছন্দ হল?
আমি রুষ্ট-নেত্রে তাকালাম তার দিকে।–ভদ্রমহিলা এ-রকম বিপদে পড়েছেন, এসব কি বলছেন আপনি!
আরো বিচ্ছিরি করে হাসল লোকটা। বলল, ভদ্রমহিলা বিপদে পড়লে আপনাদের দরদ উথলে ওঠে, না? আর সুন্দর মুখ হলে তো কথাই নেই–কোন ভদ্রলোক ও-রকম বিপদে পড়লে ফিরে তাকাতেন?
আমি বললাম, শাট আপ, ভদ্রলোকের মত কথা বলুন, ওই মহিলা কি রকম বিপদে পড়েছেন আপনি জানেন?
হাসছে তখনো।–জানি বইকি, অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার টাকা ছিল ব্যাগে–সেই ব্যাগ ছিনতাই হয়েছে, এই তো?
আমি থমকে গেলাম।ওই মহিলাকে আপনি চেনেন?
চিনি বইকি। আরো বেশি হাসতে লাগল।ওই দেখুন আরো কত জনে টাকা। পয়সা দিচ্ছে, ওয়াণ্ডারফুল!
ফিরে তাকালাম একবার। পানঅলাটা কি যেন ইশারা করছে আমাকে।
আমার ওর দিকে তাকাবার সময় নেই। রূঢ় স্বরে সামনের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কতটা চেনেন আর কি জানেন?
মুচকি হেসে সে জবাব দিল, এমনও হতে পারে ওই মহিলার সেই অসুস্থ স্বামীর সঙ্গেই আপনি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। থ্যাংকস্ ফর দি চ্যারিটি–
দ্রুত চলে গেল লোকটা।
আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। পানঅলা আমাকে বাবু বলে হাঁক দিল। কিন্তু আমি সে ডাকে কর্ণপাত না করে ওই মহিলার দিকেই ছুটে গেলাম। রাগের মাথায় এক থাবা মেরে মহিলার হাত থেকে টাকা পয়সা সব মাটিতে ফেলে দিলাম। চিৎকার করে বলে উঠলাম, মশাইরা, কেউ এক পয়সাও দেবেন না, সব জোচ্চুরি,সব মিথ্যে! মহিলা হতভম্ব মুখে চেয়ে রইল আমার দিকে। যারা চারপাশে ছিল তখনো তারাও চিত্রার্পিত।
হাতে একটা টান পড়তে চেয়ে দেখি ওই পানঅলা টানছে আমাকে। ছুটে এসে হাঁপাচ্ছে সে। বলছে, শুনুন বাবু শুনুন, খুব ভুল হোয়ে গেল
তিন হাত এদিকে টেনে এনে সে আমাকে বলল, ওই পাগলের কথা শুনে আপনি কি করছেন বাবু!
পাগল!
হ্যাঁ পাগল। দুবছর আগে ওর বউ অন্য লোকের সঙ্গে ভেগে গেছে। তারপর থেকে একটু ভাল চেহারার কোন মেয়েছেলে দেখলেই বলে তার বউ।
আমি বিমূঢ় কয়েক মুহূর্ত। ওদিকে লোকগুলোর মধ্যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া শুরু হব-হব করছে। আমি তাড়াতাড়ি এসে ছড়ানো ছিটনো টাকা পয়সাগুলো রাস্তা থেকে কুড়োতে লাগলাম। অনেকে একসঙ্গে প্রশ্ন ছুঁডল, কি হয়েছে মশাই, কি হয়েছে?
আমি জবাব দিলাম, কিছু না মশাইরা, আমার মস্ত বড় একটা ভুল হয়েছে। সবিনয়ে আবার সেই টাকা পয়সা মহিলার সামনে ধরলাম, বললাম, অপরাধ নেবেন না, নিন। মহিলা হাত বাড়িয়ে নিল। কিন্তু সেই সঙ্গে জ্বলন্ত চোখে আমার মুখটা একপ্রস্থ দগ্ধ করল।