…ট্রামে বসে আছি। রাতক্রমে জানালার ধারের সীটটাই আমার দখলে। আমার পাশে যে আধবয়সী লোকটি বসে আছে সে কেন যেন ফিরে ফিরে আমার দিকেই তাকাচ্ছে। প্রথমে খেয়াল করিনি। একটু বাদেই করলাম। আমার পথচিত্র দেখার ঝোঁকটা সে ধরতে পারেনি। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি দেখে ভাবছে এক্ষুনি হয়তো নেমে যাব আমি। উঠে দাঁড়ালেই সে জানালার ধারটার দখল নেবার জন্য প্রস্তুত।
মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সত্যি মিথ্যে যাচাইয়ের জন্য উসখুস করে উঠল ভিতরটা। আধা-আধি উঠে কোমর বেঁকিয়ে একবার নিচের দিকে ঝুঁকলাম। সাগ্রহে পাশের লোক সেই বসা-অবস্থাতেই সাঁ করে জানালার ধারে সরে গিয়ে পা তুলে আমাকে বেরুবার জায়গা করে দিল। কিন্তু ওইরকম আধাআধি উঠে আসলে আমি কি করছিলাম? হাতের টিকিট মাটিতে ফেলে ঝুঁকে সেটাই আবার কুড়িয়ে নিচ্ছিলাম। সেটা হাতে নিয়ে অবাক মুখ করে লোকটির দিকে তাকাতে সে তার ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত।
সরি!
ঠিক আছে, বসুন বসুন।
জানালার ধার ছেড়ে দিয়ে আমি তার পাশে বসেছি।
.
…ময়দানের নিরিবিলি ধারটা দিয়ে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে চলেছে। ছেলেটার বয়েস সাতাশ-আটাশ আর মেয়েটার বড় জোর উনিশ। তেমন সুশ্রী নয় আবার তেমন কুরূপাও নয় মেয়েটা। হাত মুখ নেড়ে কথা বলতে বলতে চলেছে। কিন্তু আমার মনে হল তার সঙ্গীটি কথা যত না শুনছে তার থেকে দেখছে ঢের বেশী। তার একখানা হাত মেয়েটার কাঁধের ওপর। সেই হাত পিঠ বেয়ে মাঝে মাঝে মেয়েটার কোমরের দিকে নেমে আসছে। হাত বিশেক পিছনে চলেছি আমি। মেয়েটা পলকের সন্দিগ্ধ চোখে ঘাড় বাঁকিয়ে সঙ্গীর মুখখানা দেখে নিল একবার। সঙ্গীর হাত তক্ষুনি ওর কাঁধের দিকে উঠে গেল। আর পিছনে ফিরে একবার দেখেও নিল।
আমার মন বলছে তেমন অভিজ্ঞ নয় মেয়েটা। অনেকটা সরল বিশ্বাসেই সঙ্গীর পাশে চলেছে। আর মনে হল, ওই পাশের লোকটা নিরাপদ গোছের নির্জনতা খুঁজছে একটু। সন্ধ্যার ছায়া গাঢ় হয়ে এসেছে। ওরা এগিয়ে চলেছে। একটু বাদেই আর দেখা গেল না ওদের।
আমি মাঠেই এক জায়গায় বসে পড়লাম।
আধঘন্টার মধ্যেই প্রত্যাশিত নাটক দেখলাম। অন্ধকার কুঁড়ে হনহন করে কেউ একজন এদিকে আসছে। প্রায় ছুটেই আসছে যেন। আমিও অন্ধকার বিদীর্ণ করে দেখছি। একটা মেয়েই। সেই মেয়ে। কেউ যেন ওকে তাড়া করেছে। ও পালাচ্ছে।
আমি ভুইফেঁড়ের মত সামনে উঠে দাঁড়ালাম। মেয়েটা আঁতকে উঠল।
বললাম, ভয় পেও না, দাঁড়াও–তোমার পিছনের ওই লোক এসে গেছে, এভাবে পালিয়ে পার পাবে না।
বলতে বলতে লোকটা এসে গেল। সেই লোক। দাঁড়াবে কি দাঁড়াবে না ভাবছিল। অস্ফুট গর্জনে একটা কটুক্তি করে উঠে আমি তেড়ে যেতেই সে ত্রস্ত কুকুরের মত ছুটে পালাল। আমি মেয়েটাকে বললাম, এবার যাও, আর সন্ধ্যায় হাওয়া খেতে এসো না।
অন্ধকারে আমিও পা চালিয়ে দিলাম।
.
…বাসের ঠাসাঠাসি ভিড়ের মধ্যে সেই লোকটার মুখের দিকে আমার চোখ আটকাল কেন জানি না। বেশ ফিটফাট চেহারা। পরনে চকচকে প্যান্ট ঝকঝকে শার্ট। মুখে দু-চারটে বসন্তের দাগ। বছর চব্বিশ-পঁচিশ বয়েস। সে আমাকে দেখছে না। তার চোখ আশ-পাশের মানুষদের উপর চক্কর খাচ্ছে। এই চিত্র যেন আমার ষষ্ঠ চেতনার ওপর আঘাত দিল একটা। মন বলল, লোকটা নিঃশব্দে অপরের পকেটের সন্ধানে আছে।
মিনিট কতকের জন্য একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ এক ভদ্রলোক চেঁচামেচি করে উঠল। তার পকেট থেকে মানিব্যাগ খোয়া গেছে। একটা হৈ-চৈ পড়ে গেল। আশপাশের সকলকেই সন্দেহ করছে ভদ্রলোক। আমি দেখলাম সেই লোকটি তখন বেশ দূরে দাঁড়িয়ে–অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে। আর নিস্পৃহ মুখে ঘাড় ফিরিয়ে একটা দৃশ্য দেখছে যেন।
কপাল ঠুকে একটা কাণ্ড করে বসলাম। টাকা যার খোয়া গেছে তার গা টিপে ওই লোকটাকে দেখিয়ে দিলাম। সে ছুটে গিয়ে তাকে চেপে ধরল। লোকটা পাল্টা হুমকি দিয়ে উঠল, কিন্তু মুখখানা আমসি। আরো দুচারজন উৎসাহী লোক তাকে ঘেঁকে ধরে কোমরে হাত দিতেই ব্যাগ বেরুল। তারপর বহুজনের সে কি নৃশংস উল্লাস!
.
এই থেকেই নিজের ওপর একটা দৃঢ় বিশ্বাস এসে গেছল। আমি পথচিত্র দেখি। আর তাই থেকে মানুষের ভিতরের চিত্রটাও স্পষ্ট দেখি।
সেদিন…
বেলা তখন তিনটে হবে। একটা পরিচিত ছোট রাস্তা ধরে আসছিলাম। উদ্দেশ্য মোড়ের ওই দোকান থেকে পান খাব। আমি ওই বিশেষ দোকানের খদ্দের। বলতে ণেলে এ পাড়াতেই খানিক দূরে বাসা আমার। ওই অল্পবয়সী পানঅলাটাকে খুব পছন্দ আমার। দেশ উড়িষ্যায়। এখন বাঙালীই হয়ে গেছে। সব সময় মিষ্টি মিষ্টি হাসে, পান সাজার ফাঁকে শরীর কেমন আছে না আছে খবর নেয়। মজাদার টাটকা খবর কিছু থাকলে তাও বলে ফেলে।
গজ বিশেক এ-ধারেই দাঁড়িয়ে পড়তে হল। সামনে কিসের জটলা একটা। একজন মহিলা–বছর পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে বয়সে, ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আর চারদিক থেকে তাকে ঘিরে অনেকে অনেক রকমের কথা বলছে। কেউ কেউ এটা সেটা জেরা করছে। মহিলাকে, কিন্তু উদগত কান্না চেপে মহিলা জবাব দিয়ে উঠতে পারছে না। হাত তুলে। সামনের গলিটা দেখিয়ে দিচ্ছে কেবল।
আমিও দাঁড়িয়ে গেছি। সমাচার যা শুনলাম তার সারমর্ম, মহিলা আজ সকালেই তার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে পঁচাত্তরটি টাকা স্বামীর চিকিৎসার জন্য ধার করে এনেছে। স্বামী একেবারে শয্যাশায়ী। ঘরে আর এক কপর্দকও নেই। ওই টাকায় স্বামীর। জন্য ওষুধ আসবে আর তার বুকের এক্স-রে হবে। মহিলা আগে ওষুধটা কিনে নিয়ে বাড়ি যাবে ঠিক করে এ-পথ দিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে একটা লোক ছোঁ মেরে তার হাতের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে ওই গলিতে সেঁধিয়ে গেছে। মহিলা বুক চাপড়ে কেঁদে উঠেছে। কিন্তু গলির ভিতর দিয়ে লোকটা কোথা থেকে কোথায় চলে গেছে ঠিক কি।