বাড়ির সেক্রেটারিকে ডেকে চৌধুরীমশাই হুকুম করলেন, বৃন্দাবনের দুশ টাকা মাইনে আর তিনশটা বাড়তি টাকা নিজে গিয়ে বৃন্দাবনের বউয়ের হাতে দিয়ে আসতে। আর অমলকে বললেন, সে ইচ্ছে করলে বৃন্দাবনের কাজ করতে পারে, কিন্তু তার মত খাঁটি হওয়া চাই।
মনে মনে বুড়ো হাঙরের মুণ্ডপাত করতে করতে সেক্রেটারিকে সঙ্গে করে ডেরায় ফিরল। মেয়েজাতটার ওপরে সে এখন মর্মান্তিক ক্রুদ্ধ। তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়ে অতসীকে টেনে এনে ঘরের মেঝেতে বসিয়ে দিল। পরনের কালো পেড়ে শাড়ির আঁচলে নিজেই ওর মাথা আর মুখ ঢেকে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, খবরদার একটা কথাও বলবি না, মালিকের সেক্রেটারি টাকা দিতে আসছে।
ছুটে গিয়ে সেক্রেটারিকে ডেকে নিয়ে এল। সে ভদ্রলোক মালিকের বক্তব্য শুনিয়ে। সামনে পাঁচশ টাকা রেখে চলে গেল।
অমল দাস ফিরে এসে দেখে অতসী তেমনি ঘোমটায় মুখ ঢেকে বসে আছে, কিন্তু সামনে টাকা নেই।
টাকাগুলো দে।
এক ঝটকায় ঘোমটা সরিয়ে ফেলে ছদ্মকোপে অতসী বলল, আমাকে বিধবা সাজিয়ে টাকার কথা বলতে লজ্জা করে না তোমার? পাবে না যাও
এই রাগটুকু দেখতে কেন যেন অমল দাসের ভাল লাগল। বৃন্দাদা চলে যাবার পর থেকেই কেন যে অমলের দুচোখ থেকে থেকে ওর দিকে ফেরে ঠিক বুঝে ওঠে না। কিন্তু মেয়েছেলেকে আর এই জীবনে আমল দেবে না ও-বৃন্দাদা অসময়ে চলে গেল, ওরাই যত সর্বনাশের মূল। অতসীকে ওই বুড়ো হাঙরের কাছেই দিয়ে আসবে, তাতে মোটা কিছু টাকাও হাতে আসবে। তারপর এই কাজে ইস্তাফা দেবে।
অতএব অতসীকে না রাগিয়ে একটু ভেবে চিন্তে আপোসের সুরে বলল, ঠিক আছে ওই পাঁচশ থেকে আড়াইশ টাকা আমাকে দে, অর্ধেক তোর অর্ধেক আমার
অতসী জবাব দিল, সবটাই তোমার সবটাই আমার।
বিরক্ত হয়ে অমল চোখ পাকাল, তোর মতলবখানা কি শুনি?
পাল্টা ঝাঁঝে অতসী বলে উঠল, ছোটলোকের মত আর তুই-তোকারি করবে না বলে দিলাম! কোপের মুখেই হাসল আবার-মতলব ভাল, টাকার কথাই ভাবছিলাম দুদিন ধরে, ভগবান জুটিয়ে দিলেন–তোমার বৃন্দাদার মত ওই সব জঘন্য কাজ আর তোমার করা হবে না-ওই মোড়ের মাথায় একটা পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান দাও–আমি তোমাকে পান সাজা শিখিয়ে দেব, আর ফাঁক মত নিজেও দোকানে বধ্ব। ফিক করে হাসল আবার, দোকানে সব পান খাওয়ার হিড়িক দেখবে তখন
অমল দাস তার অবাধ্য চোখ দুটোকে জোর করেই শাসনের গাম্ভীর্যে টেনে আনল।–তারপর?
তারপর নয় তার আগে–তার আগে বিয়ে।
অমল দাস জোর দিয়েই ঝাঁঝিয়ে উঠল, কার সঙ্গে কার বিয়ে?
আমার সঙ্গে শ্রী অমলচন্দ্র দাসের।
অসহিষ্ণু ঝাঁঝে একটা প্রলোভন থেকে নিজেকে ছিনিয়ে আনতে চাইল অমল দাস। ক্রদ্ধ মুখে বলল আমাকে ওই ফাঁদে পা দেবার মত আহাম্মক পেয়েছিস? বৃন্দাদা অকালে চলে গেল তোদের জন্যে–মেয়েগুলোর জন্যেই সক্কলে মরে বুঝলি? আমি ওর মধ্যে নেই।
অতসী তার মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। নির্লিপ্ত মুখ। জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের মালিক চৌধুরীমশাইয়ের বয়েস কত?
সঠিক না বুঝেই অমল জবাব দিল বাহাত্তর ছাড়িয়েছে।
আর তোমার বৃন্দাদা কত বছর বয়সে গেল?
চল্লিশের আগে।
তাহলে?
কি তাহলে?
অতসী আরো গম্ভীর জবাব দিল, তাহলে প্রমাণ হল তুমি একটি পয়লা নম্বরের গবেট। মেয়েদের জন্যে মরলে চৌধুরীমশাই আরো তিরিশ বছর আগে মরে ভূত হয়ে যেত–মেয়েদের জন্যে কেউ মরে না, অন্যের জন্য মেয়েদের যাদের তাড়া করে। বেড়াতে হয় তারাই শুধু মরে।
অমল দাস হাঁ করে শুনল। তারপর হঠাৎই যেন কিছু তত্ত্বজ্ঞান লাভ হল তার। প্রশংসা-ভরা চোখে জ্ঞানদাত্রীটির দিকে চেয়ে রইল সে।
অতসী মেঝেতে বসেই ছিল তেমনি। এক লাফে এগিয়ে এসে তাকে আচমকা জাপটে ধরে মেঝের ওপরেই গড়াগড়ি খেতে লাগল অমল দাস।
পথচিত্র
আমার ভাল লাগে। পথে নেমে নিঃশব্দে আমি জীবন-চিত্র দেখি। জীবনের মিছিল দেখি। কেউ আমাকে কিছু দেখায় না। চলমান মানুষগুলো নিজেরা আপনা থেকে এক একটা চিত্র হয়ে আমার সামনে আসে আবার দূরে চলে যায়।
কোন কাজ না থাকলে আমি পথে নেমে আসি। নিরুদ্দিষ্টের মত হাঁটতে থাকি এক-একটা দিক ধরে। খেয়ালখুশি মত কখনো কোন ট্রামে উঠে পড়ি কখনো বা বাসে। কেউ বুঝতে পারে না আমি একজন বেকার দর্শক মাত্র। দেখাটা আমার নেশা।
দেখে দেখে মনে হয় প্রতিটি মানুষের ভিতরে যেন একটা করে সংকল্পের মোটর বসানো। সেই মোটরের দম-মাফিক তাদের ওঠা বসা চলা ফেরা কাদা হাসা। মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে আমি তাদের ভিতরের সঙ্কল্পটি আঁচ করতে চেষ্টা করি। ঠিক হয়। কিনা আমি জানি না। কিন্তু ভাল লাগে। বিশ্বাস, ঠিকও হয়।
বাসের গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে একসঙ্গে পাঁচ সাতটা মুখ আমার মুখের ওপর। চড়াও হতে দেখেছি। আমার সামনের আসনে-বসা লোকটা উসখুস করছে। নেবে যাবার জন্য সে এক্ষুনি উঠে দাঁড়াবে মনে হয়। আমার চারদিকের লোকগুলোর জোড়া জোড়া চোখ আমারই মুখের ওপর আটকে আছে কেন তক্ষুনি বোঝা গেল। যে লোকটার সীট ছেড়ে ওঠার সম্ভাবনা তার একেবারে সামনেই আমি। অর্থাৎ সে উঠলে আমারই। ওই সীটটা দখলের সম্ভাবনা।
বসা লোকটা উঠল ঠিকই। সেই মুহূর্তে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যমনস্কের মত আর এক দিকে মুখ ফিরিয়ে আছি। তক্ষুনি হুটোপুটি কাণ্ড বেধে গেল আমার দুপাশে। ওই অন্যমনস্কতার ফাঁকে দুদিকের লোকই সেই খালি সীটের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।