কেন, আমাকে বিয়ে করতে চায় বলে? তা তোমার আপত্তি থাকে তো জোর। দিয়ে বল না?
আমার কি দায় পড়েছে?
তাহলে কুপরামর্শ দিচ্ছিলে কেন?
দিচ্ছিলাম মেয়ে জাতটা অতি অখাদ্য জিনিস বলে।
অতসী হেসে ফেলল।–দুই একটা মেয়ে খেয়ে দেখেছ? বলে হাসতে হাসতেই পালাল সেখান থেকে।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে অতসীর বেশ ভাবনাই ধরে গেল। এখান থেকে নড়ার ইচ্ছে একটুও নেই। কিন্তু বৃন্দাবন পাল বিয়ে করতে চাইলেই বা ঠেকাবে কি করে? তাকে বিয়ে করার ইচ্ছে একটুও নেই। ওদিকে আর একজন তো কাছে গেলেই মারতে আসে।
ইনিয়ে বিনিয়ে বৃন্দাবন প্রস্তাবটা করেই ফেলল একদিন। তার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। প্রায়ই একটু একটু জ্বর আর বুকের ব্যথায় ভুগছে। তাই মাঝে মাঝে আর কাজে বেরোয় না। সেই অবকাশে একদিন কথাটা বলে ফেলল।
শুনে অতসী ভয়ানক বিমর্ষ।–তা তো এখন হয় না। কেন? কেন হয় না?
আমার যে ভয়ানক ফাড়াআছে। জ্যোতিষী আমাকে দেখে মাকে আর বাবাকে বলেছিল। ফাড়ানা কাটতে বিয়ে হলে আমারও ক্ষতি হবে, যে বিয়ে করবে তারও খুব অনিষ্ট হবে। এই জন্যেই তো বাবা ঘরে রেখেছিল–
বৃন্দাবন চিন্তিত। কতদিন ফাড়া আছে?
একুশের মাঝামাঝি পর্যন্ত।
এখন কত?
এই কুডির মাঝামাঝি।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল বৃন্দাবন, একটা বছর এমন কিছু দীর্ঘ নয়। তার পরেই কি মনে পড়তে পুলকিত। সেও তো গণক ঠাকুর দিয়ে হাত আর ঠিকুজী দেখিয়ে রেখেছে, আরো এক বছরের মধ্যে তার দিন ফেরার কথা। যোগাযোগ একেই বলে, দিন তাহলে সর্বরকম ভাবেই বদলাবে।
অতসীর ফাড়া কাটার কথা আর প্রায় একই সময় নিজের দিন বদলের কথা অমলকে না বলে পারেনি বৃন্দাবন। তুই তো কিছুই বিশ্বাস করিস না, কেমন মেলে দেখ এখন
শুনে অমল ভুরু কুঁচকেছে শুধু। এসব প্রসঙ্গই বিরক্তিকর তার কাছে।
বিরক্তি দিন দিন বাড়তেই থাকল, কারণ ভয়-ডর গিয়ে অতসীর হামলা দিনে দিনে বাড়ছে তার ওপর। কারণে অকারণে ঝগড়া করে, আবার বৃন্দাদার কাছে নালিশ করে ওকে বকুনি খাওয়াতে চেষ্টা করে। ওর কাজের জিনিস লুকিয়ে রাখে, ইচ্ছে করে জামার বোতাম ভেঙে রাখে। নিজেই অবশ্য আবার বার করে দেয়, বা পরিপাটি করে নতুন বোতাম লাগিয়ে দেয়। সেলাই করতে করতে দাতে করে সুতো কাটে যখন, অমলের দেখতে এক এক সময় ভালই লাগে। কিন্তু ভাল লাগার মেজাজ সব সময় থাকে না। উল্টে বেশির ভাগ সময় হাত নিশপিশ করে। কিন্তু গায়ে আঙুল তুললে বৃন্দাদার কাছে দশখানা করে লাগায়।
রেগে গিয়ে অমল বলে, তুই এখন থেকেই চাস না যে আমি এখানে থাকি নিজের একটা পেট আমি চালাতে পারব না ভাবিস, কেমন?
গম্ভীর মুখে অতসী জবাব দেয়, একটা পারবে, দুটো পারবে কিনা আমার সেই ভাবনা।
কি, বৃন্দাদার মত হাঁদা পেয়েছিস আমাকে? আমি যাব ঝামেলা বাড়াতে! বৃন্দাদা ছাড়ছে না বলে, নইলে আমি পালাতেই চাই, বুঝলি? তোর ফাড়া কাটতে আর বাকি কত?
ভাল মুখ করে অতসী-জবাব দেয়, সে-তত তোমার ওপর নির্ভর করছে–কাটিয়ে দাও না চট করে।
অমল দাস ভাবে, পূজো আর্চা দেওয়া বা জ্যোতিষীর কাছে ধরনা দেওয়ার অনুরোধ। জবাব দেয়, আমার দ্বারা কিছু হবে না, আমার সময়ও নেই আর ওসব কিছু বিশ্বাসও করি না। নিজেদেরটা নিজেরা বোঝগে যাও-বড় নিশ্বাস ফেলে অতসী জবাব দেয়, মেয়েছেলে…কত আর পারি।
এক বছরের দরকার হল না, মাস আষ্টেকের মধ্যে বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই দিন বদলের চাকাটা ঘুরে গেল। অতসীর ফাড়া কাটল, কিন্তু এতটা অকরুণভাবে কাটাতে চায়নি সে।
বৃন্দাবন আগের থেকে আরো বেশি ভুগছিল। কিন্তু মনিবের ভ্রূকুটির ভয়ে আর রোজগারের আশায় অসুস্থ শরীর নিয়েই কাজে বেরুতে হত। এরই মধ্যে অঘটন ঘটে গেল। মনিবের কাছে মোটা বখশিসের ইংগিত পেয়ে একটি মোটামুটি শিক্ষিতা মেয়েকে লোভের টোপে প্রায় আটকে ফেলেছে ভেবেছিল। অদূর ভবিষ্যতে ছবির নায়িকা হয়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথাও বলেছিল তাকে। আর মনিবের সঙ্গে দেখাসাক্ষংও করিয়ে দিয়েছিল।…মেয়েটার বোধহয় ভালবাসার লোক ছিল একজন, কিন্তু তা নিয়ে বৃন্দাবন মাথা ঘামায়নি। অমন অনেক দেখেছে। কিন্তু সেই ভালবাসার লোক আর দুটো ষণ্ডামার্কা লোকের সঙ্গে দিনমানে খোলা রাস্তায় তার ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল–তারপর বেদম মার। মুখে বুকে পিঠে কিল চড় লাথি। নাক মুখ দিয়ে গল গল করে রক্ত বেরুতে লাগল। বৃন্দাবন পাল অজ্ঞান হয়ে মাটিতে গড়াতে লাগল।
তারপর হাসপাতাল। প্রায় সন্ধ্যার মুখে খবর পেয়ে অমল আর অতসী হাসপাতালে ছুটেছে। ওদের দেখে বৃন্দাবন কেঁদে ভাসিয়েছে।
দিন তিনেকের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছিল। আর একটা দিন গেলেই বাড়ি ফেরার কথা। পরদিন বিকেলে তাকে আনতে গিয়ে অমল আর অতসী শোনে বৃন্দাবন পাল মরে গেছে। ডাক্তার জানালো, রাতে করোনারি অ্যাটাক হয়েছিল, দুপুরের মধ্যে শেষ।
দিন তিনেকের চেষ্টায় অমল দাস কর্তা চৌধুরীমশায়ের নাগাল পেল। নতুন ছবি নিয়ে খুবই ব্যস্ত তিনি। বৃন্দাবনের মৃত্যুর খবর কানে এসেছে আগেই। অমলকে পরে। দেখা করতে বলেছিলেন।
বৃন্দাবনের জন্য দুঃখ করলেন একটু চৌধুরীমশাই। বড় কাজের লোক ছিল বললেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ওর বউটার কি দশা?
বৃন্দাবনের বউ পালানোর খবর চৌধুরীমশাই রাখেন না বোঝামাত্র অমল দাস শুকনো মুখে জানিয়ে দিল, পাগলের মত হয়ে আছে–এদিকে ঘরে একটা কপর্দকও নেই।