- বইয়ের নামঃ মডেল
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
আচরণ
সুমিত্রা সিংহর বয়েস এখন আটচল্লিশ। কিন্তু মেয়েদের কাছে আটষট্টির মুখোস এঁটে থাকেন সর্বদা। শুধু মেয়েদের কাছে কেন, নানা বয়সের বিয়াল্লিশজন শিক্ষয়িত্রীও তার প্রায় মৌন অনুশাসনের ভয়ে সন্ত্রস্ত। বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘরে ডাক পড়লে তারাও খুব স্বস্তি বোধ করেন না।
চারশো মেয়ে, বিয়াল্লিশজন শিক্ষয়িত্রী, স্কুল বাস-এর জনাকয়েক ড্রাইভার আর ক্লিনার, চারজন ঝাড়ুদার, তিনটে মালী আর হস্টেলের মেট্রন আর কিছু ঝি-চাকর নিয়ে সুমিত্রা সিংহর সাম্রাজ্য। ছোট ব্যাপার কিছু নয়। সকলের সকল স্বার্থ বজায় রেখে নিয়ম শৃঙ্খলার সঙ্গে একটা স্কুল চালানো বেশ ধকলের কাজ। আজ ছবছর ধরে শক্ত হাতে এই প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরে আছেন তিনি। স্কুল কর্তৃপক্ষ নির্বিবাদে এখন তার সব সুপারিশ মেনে চলেন। সব থেকে উঁচু আসনটি তাঁর দখলে আসার পর থেকে বছরের পর বছর বোর্ডের পরীক্ষার রেজাল্ট দেখছেন তারা। শুধু এরই ফলে স্কুলে প্রতি বছর নতুন ভর্তির হিড়িক সামলানো দায়। কোন ক্লাসে সাতটা সীট খালি থাকলে তিনশো মেয়ে পরীক্ষা দিতে বসে যায়। এ ব্যাপারে হোমরা চোমরাদের সুপারিশ অচল। তাছাড়া সুমিত্রা সিংহ আসার পর গার্জেনদের অবুঝ দাপট কমেছে, শিক্ষয়িত্রীদের দলাদলি গেছে। হবিতম্বি করতে এসে অনেক গার্জেনকে মুখ বুজে মেয়ের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে হয়েছে। কয়েকজন অকেজো বা অবাধ্য টিচারকে অবসর নিয়ে যেতে হয়েছে। সর্বাধিনায়িকাটির সুনজরে পড়তে হলে ক্লাসের। মেয়েদের ভালর জন্যে প্রাণপাত করতে হবে–এ এখন সব শিক্ষয়িত্রীরাই বুঝে নিয়েছেন।
বেশি পরিশ্রম করতে হয় বলে সকলেই তুষ্ট নয়। এত দাপট দেখে ভিতরে ভিতরে কারো বা ঈর্ষা। তারা দেমাক দেখেন, দম্ভ দেখেন। রূপের দেমাক। রূপসী আদৌ নন, কিন্তু সুশ্রী বটেই। তাছাড়া স্বাস্থ্যের বাঁধুনি এমন যে আটচল্লিশ বছর বয়সটাকে অনায়াসে চল্লিশে টেনে নামানো যায়। আর এদের চোখে দম্ভ বলতে শিক্ষার দম্ভ। ইংরেজিতে কলকাতার এম, এ আর এম, এড। সুযোগ সুবিধে পেলে ওরকম বিলেতি ছাপ যে কেউ নিয়ে আসতে পারে। বেড়ালের ভাগ্যে ক্কচিৎ কখনও শিকে ঘেঁড়েও। স্কুলমাস্টারি করতে করতে হঠাৎ সরকারী দাক্ষিণ্যের সুযোগে সুমিত্রা সিংহও তেমনি কিছুদিন বিলেতে ঘুরে এসেছেন। আড়ালে আবডালে এই সরকারী দাক্ষিণ্য লাভের ব্যাপারেও কেউ কেউ জটিল সংশয়ের ছায়া ফেলতে ছাড়েন না। বয়েসকালের সুশ্রী মেয়ের সুপটু তোষামোদে কত কি হয়, কত কি হতে পারে। কিন্তু দেয়ালেরও কান আছে। একান্ত বিশ্বস্তজন ভিন্ন কারো মনের কথা মুখে ফোটে না।
সুমিত্রা সিংহ যেখান দিয়ে হাঁটেন চলেন, শিক্ষয়িত্রীরা ঠাণ্ডা, মেয়েরাও সন্ত্রস্ত। আর ঘরে ডাক পড়লে তো কথাই নেই, ভিতরে ভিতরে ঘাম হতে থাকে।
সুমিত্রা সিংহর বাড়ির চালচলনেও রকমফের নেই খুব। এখানেও একটা হালকা গাম্ভীর্য ছুঁয়ে আছে তাকে। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে নতুন ডাক্তার, মেয়ে কলেজে পড়ে। ছেলে আর মেয়ে তাদের ডক্টরেট বাপের থেকে মাকে বেশি সমীহ করে। ডক্টরেট ভদ্রলোক ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বই পড়েন আর থেকে থেকে স্ত্রীর গম্ভীর মুখের ওপর দুচোখের কৌতুক ছড়ান। সেটা কখনও-সখনও ধরা পড়ে না এমন নয়।
স্ত্রীটি তখন থমকে তাকান।
–কি?
কি?
হাসছ মনে হচ্ছে?
এটা সেটা বলে ভদ্রলোক সামলে নেন। য়ুনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের প্রফেসার তিনি। আপন মনে হাসার অনেক কারণ তার ঠোঁটের ডগায় মজুত। মহিলার তখনো প্রধান শিক্ষয়িত্রীর সন্দিগ্ধ চোখ। এ নিয়ে এই সেদিন আরো একটু মজার ব্যাপার ঘটে গেছল। শনিবার বিকেল চারটের মধ্যে বাড়ি ফিরেছিলেন। ডক্টর সিংহ অন্য দিনের মতোই বই হাতে ইজিচেয়ারে শয়ান। ভদ্রলোকের দুতিন ঘণ্টার বেশি ক্লাস থাকে না বলে স্ত্রী তার চাকরিটাকে ফাঁকিবাজী ছাড়া আর কিছু ভাবেন না! এক এক সময় খোঁটাও দেন–মাস্টাররা যে রকম পরিশ্রমকাতর ছেলেরা কত আর মানুষ হবে!
সুমিত্রা সিংহর মেজাজ খুব প্রসন্ন ছিল না সেদিন। স্কুলের কোন একটা ভাবনা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। তারপর প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে সেই চিন্তা করেছেন, মাঝে মাঝে ভুরু কুঁচকে ঘরে আর সামনের বারান্দায় পায়চারি করেছেন।
হঠাৎই এক সময় খেয়াল হল বই কোলের ওপর ফেলে স্বামীটি সকৌতুকে চেয়ে আছেন তাঁর দিকে। ভুরুর ভাজ আরো একটু ঘন হল–হাসছ যে?
ভদ্রলোক সেদিন সত্যি কথাই বললেন। জবাব দিলেন, তোমাকে দেখে।
আমাকে দেখে হাসছ মানে?
বাজারে সাদা কলপ কিনতে পাওয়া যায় কিনা দেখো, তোমার এই চালচলন মানাচ্ছে না।
তার মানে?
কাছে এস, বলছি।
সত্যিই এখন শুধু সমস্যার জগৎ আর চিন্তার জগতে বাস মিসেস সুমিত্রা সিংহর। সঠিক না বুঝে কাছে এসে দাঁড়ালেন। হাত ধরে আচমকা আরো কাছে টেনে যে কাণ্ডটা করে বসলেন ভদ্রলোক দিশেহারার মত ছিটকে সরে দাঁড়ালেন মহিলা। আরক্ত মুখে আর অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলেন খানিক। ভদ্রলোক কৈফিয়ৎ দিলেন, সেজন্যেই তো সাদা কলপের কথা বলছিলাম, তোমাকে দেখলে আমার এখনো এই সাধ জাগে তো কি করব।
সুমিত্রা সিংহ এরপর পনেরো মিনিট ধরে শাসালেন তাঁকে। শোওয়ার ঘর আলাদা করে দেবার হুমকি দিলেন, বয়েস কালের ধর্ম আর শৃঙ্খলা মেনে চলার কথা বললেন, দরজা কপাট হাঁ করা খোলা, ছেলেমেয়েরা একজন কেউ দেখে ফেললে কি কাণ্ড হত সে কথা পাঁচবার করে শোনালেন।