শরীরটা আসলে আমারই খুব খারাপ লাগছিল। মাথাটা সেই থেকে ধরে আছে, আর এখন বেজায় টন টন করছে। এই এক রোগ আমার। তখন কড়া ঘুমের বড়ি খেয়ে পড়ে থাকতে নয়, নইলে সমস্ত রাত ধরে যন্ত্রণা চলবে। সেই ট্যাবলেট সঙ্গেই থাকে। খাওয়া শেষ করে স্যুটকেস থেকে ট্যাবলেটের শিশিটা বার করতে দেখে মজুমদার মশাই টেনে টেনে জিজ্ঞেস করলেন, কি ওটা?
-ঘুমের ওষুধ, মাথায় বড় যন্ত্রণা হচ্ছে সেই থেকে।
মজুমদার মশাই হেসে উঠলেন, বললেন, একেই বলে কপাল, যন্ত্রণার আর ঘুমের এমন মহৌষধ হাতের কাছে থাকতে আপনি ট্যাবলেট গিলছেন!
মিলুর খাওয়া আগেই হয়ে গেছল। এদেরও শেষ। ডিশ আর পাত্রগুলো সব একত্র করে হিরু গুপ্ত বাইরের করিডোরে রেখে এলো। নীচে খবরের কাগজ পাতা হয়েছিল, সেগুলো জড়ো করে জানালা দিয়ে ফেলে দিল। তারপর মুখ হাত ধুয়ে। মুহে সে বাইরে সিগারেট খেতে যাওয়ার উদ্যোগ করতে মজুমদার মশাই আবেদনের সুরে বললেন, আমার বিছানাটা আগে ঠিক করে দিয়ে যা–
অর্থাৎ তিনি আর বসতেও পারছেন না। কোনরকম উঠে ধপ করে মিলুর পাশে বসলেন। হিরু গুপ্ত তৎপর হাতে তার শয্যারচনা করে দিতে তিনি সেটি গ্রহণ করে বাঁচলেন যেন।
মিলুর শয্যাও একই সঙ্গে বিছানো হয়ে গেল। আমার কেমন মনে হল, ও যেন একটু বেশি চুপচাপ এখন। আমি ততক্ষণে আমার বার্থে উঠে গা এলিয়ে দিয়েছি। মি তার জানালার পাশে বসল। চড়া বাতিগুলো নিভিয়ে দিয়ে হিরু গুপ্ত সবুজ আলোটা জ্বালতে মজুমদার মশাই বিড় বিড় করে উঠলেন, নিভিয়ে দে, নিভিয়ে দে–কি দরকার!
অতএব সেটাও নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে হিরু গুপ্ত বাইরে সিগারেট খেতে গেল। আর তার দুমিনিটের মধ্যে মজুমদার মশায়ের পরিতৃপ্ত নাসিকা-গর্জন শোনা যেতে লাগল।
আমি হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করছি কেন একটু, জানি না। মিনিট পনেরো বাদে হিরু ও নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল টের পেলাম। ঘুমে তখন দুচোখ বুজে আসছে আমার। ভিতর থেকে দরজা লক করে ঘুরে দাঁড়াল। অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়েই রইল একটু। জানলা খোলা থাকায় নীচের দিকটা সামান্য আবছা দেখা যাচ্ছে। ওপরটা একেবারে অন্ধকার।
হিরু গুপ্ত পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে মিলুর বেঞ্চির অন্য ধার ঘেঁষে বসল। এক্ষণি আপার বার্থে উঠে শোবার ইচ্ছে নেই বোধহয়। মজুমদার মশাইয়ের নাকের গর্জন বেড়েছে। মিলু জানলার দিকে মুখ করে বসে আছে।
ঘুমে চোখ তাকাতে পারছি না, কিন্তু ভিতরের অস্বস্তি বাড়ছেই। মিলুর মুখে শঙ্কার ছায়া দেখেছিলাম কেন–হিরু গুপ্ত মদ খাচ্ছে না বলে?
অস্বস্তি নিয়েই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলাম হয়তো। কতক্ষণ কেটেছে জানি না। চোখ টান করে দেখি মিলু তেমনি জানলার কাছে বসে আছে, আর হিরু গুপ্ত ওখানে বসেই সিগারেট টানছে–সস্তা কড়া সিগারেটের উগ্র গন্ধ নাকে আসছে।
হঠাৎ রাগই হচ্ছে আমার। কিন্তু বেশিক্ষণ চোখ তাকিয়ে থাকা গেল না। এবারে ঘুমিয়েই পড়লাম।
কিন্তু ভিতরের অস্বস্তিটাই আবার আমাকে জাগিয়ে দিয়েছে কিনা জানি না। যে দৃশ্য দেখলাম, ভিতরটা ধড়ফড় করে উঠল। মিলু জানলার কাছ থেকে সরে এসেছে। আর হিরু গুপ্ত খানিকটা ওধারে সরেছে। দুজনের মাঝে বড়জোড় হাত খানেক ফারাক। সেটুকুও কমিয়ে আনার জন্য হিরু গুপ্ত মিলুর একখানা বাহু ধরে টানাটানি করছে, আর মিলু একবার তার হাত ঠেলে সরাচ্ছে আর দুহাতে এক-একবার ধাক্কা দিয়ে। তাকে বেঞ্চির ওধারে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। ফলে হিরু গুপ্তর। উপদ্রবের চেষ্টাটা এক-একবার আরো অশালীন হয়ে উঠছে।
দুজনের কারো মুখে ফিস ফিস শব্দটিও নেই। শুধু মজুমদার মশাইয়ের নাকের গর্জন শোনা যাচ্ছে।
মাথায় রক্ত উঠছে আমার। চিৎকার করে ধমকে উঠতে ইচ্ছে করছিল। এদের এই নিঃশব্দ লীলা কতদূর গড়াবে আরো?
গাড়ির গতি হঠাৎ শ্লথ হয়ে আসতে নীচের ওই দুজন সচেতন একটু। হয়তো স্টেশন আসছে। গতি কমছেই। শেষে বিচ্ছিরি রকমের একটা ঘটাং-ঘটাং শব্দ করে গাড়িটা থেমেই গেল। সেই শব্দে যেন ঘুম ভাঙল আমার। গলা-খাঁকারি দিয়ে আড়মোড়া ভাঙলাম। তারপর উঠে বসলাম।
হিরু গুপ্ত ততক্ষণে বেঞ্চির এধারে সরে এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, স্টেশন নাকি?
–না, এমনি থেমেছে।
–আপনি শোননি এখনো? কটা বাজল?
অন্ধকারেই ঘড়ি দেখে জবাব দিল, একটা। আমার অত চট করে ঘুম আসে না। একটু বাদেই গাড়ি চলতে শুরু করল আবার। আর আমিই বা শুয়ে না পড়ে কি করব! বেশ খানিকক্ষণ জেগেই ছিলাম, ওরা তফাতেই বসে আছে। শেষে ঘুমের জ্বালায় অস্থির হয়ে ওদের দুজনকেই মনে মনে জাহান্নমে পাঠিয়ে ও-পাশ ফিরলাম।
আবার যখন ঘুম ভাঙল, সকাল।
হিরু গুপ্ত আপার বার্থে অঘোরে ঘুমুচ্ছে। নীচে মজুমদার মশাইয়ের ঘুম ভাঙেনি তখনো। মিলু জানলার পাশে বসে আছে। একটু আগে মুখে-চোখে জল দিয়ে এসেছে। বোধহয়। ভেজা-ভেজা মুখখানা মিষ্টি। কিন্তু আমার কুৎসিত লাগছে। রাতের লীলা কোন পর্যন্ত গড়িয়েছে আমি জানি না।
আটটায় পৌঁছবার কথা। সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ সকলে উঠে পড়েছে।
মনে হল মিলু আর হিরু গুপ্ত এক-একবার আমাকে লক্ষ্য করছে। আমি ওদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছি না বলেই হয়তো।
গাড়িটা একটা গণ্ডগ্রামের মত জায়গায় থেমে আছে কেন বুঝছি না। ধারে-কাছে লোকালয় নেই। দুদিকে খাঁ-খাঁ মাঠে আধা-শুকনো একটা বিল–দূরে জঙ্গলের রেখা।