এখন সেই মেয়েরই নাকি খিদে হয় না, সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না!
দুজনেই চুপচাপ খানিক। চাপা আগ্রহে হঠাৎ হিরু গুপ্ত আবার বলল, কলকাতার। সেই হোটেলে আপনিও যেন কি বলেছিলেন–আমার যন্ত্রণার একটা ভাগ আর একজনও পাচ্ছে নাকি–সত্যি যন্ত্রণা পাচ্ছে? বলুন না?
মহিলার সপ্রতিভ মিষ্টি মুখখানা চোখে লেগে আছে। আজ আর হিরু ও গুর কথায় সায় দিতে পারা গেল না। বললাম, সেদিন কি বলেছিলাম মনে পড়ছে না–তবে সে রকম যন্ত্রণা কিছু পুষছেন বলেও তো মনে হয় না।
মিলু মজুমদার পরস্ত্রী হিরু গুপ্ত এই ভবিতব্যটা মেনে নিক এটুকু আমার কাম্য। তাই বলা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লোকটার মুখ থমথমে আবার। সিগারেটে দুটো অসহিষ্ণু টান দিয়ে বিড়বিড় করে বলল, আপনার মতে তাহলে উনি সুখের সাগরে ভাসছেন এখন, কেমন? কিন্তু ও নির্বোধ না হলে এতদিনে এও ওর বোঝা উচিত, সব সুখ আমি ঝাঁঝরা করে দিতে পারি–এই দুনিয়ায় দাদা আমাকেই সব থেকে বেশি বিশ্বাস করে, আমার ওপরই সব থেকে বেশি নির্ভর করে। ওকে ছাড়া দাদার চলতে পারে কিন্তু আমাকে ছাড়া চলে না সেটা ও জানে।
বিরক্তি গোপন করে জবাব দিলাম, ভালই যদি বাসেন তো এতবড় ক্ষতি আপনি করবেন কেন?
যন্ত্রণাপ্রসঙ্গে আমার সেই মন্তব্যের ফলেই মিলু মজুমদারের সঙ্গে তার পরের আচরণ আরো রুক্ষ হয়ে উঠল কিনা জানি না। কেবিনে ঢুকেও তার সঙ্গে আর কথাবার্তা কইতে দেখলাম না। তার রাগ মহিলা ঠিকই আঁচ করেছে মনে হল। তার তোয়াজের মুখ একটু। কিন্তু হিরু গুপ্ত নির্লিপ্ত, কঠিন।
ভোজের ব্যাপারে রসিক দেখলাম বটে আমার সহযাত্রী দুজন। চব্বিশ ঘণ্টার রাস্তার জন্য এত খাবারও কেউ আনে কল্পনা করা যায় না। বড় বড় অনেকগুলো ডিশে হিরু গুপ্তই একরাশ করে দুপুরের খাবার সাজালো। তারপর কতকগুলো ডিশ আমার আর তার দাদার দিকে ঠেলে দিল আর বাকি কটা নিজের দিকে টেনে নিল। মহিলা খাবে কি খাবে না তা নিয়ে যেন তার কোন মাথাব্যথা নেই।
মজুমদার মশাই ভাইয়ের রাগ দেখে মুখ টিপে হাসছেন। আমার চোখে চোখ। পড়তে মিলু বিড়ম্বনার ভাবটা কাটিয়ে সহজ হাসিমুখেই দেওরের দিকে তাকাল– আমাকে দিলে না?
মুখ ঈষৎ বিকৃত করে হিরু গুপ্ত তিক্ত প্রশ্ন ছুঁড়ল, আমার ছোঁয়া তোমার চলবে?
হাসি-হাসি মুখেই মিলু মাথা নাড়ল–অর্থাৎ চলবে।
এই তোষামোদেও হিরু গুপ্তর মেজাজ নরম হল না। সে নিবিষ্ট রুক্ষ মুখে। খাবার চালান করতে লাগল। হাসিমুখে মজুমদার মশাই চাপা গলায় আমাকে বললেন, বেজায় ক্ষেপেছে দেখছি আজ… আবার ভাব হতেও খুব বেশি সময় লাগবে না, আপনি খান!
তবু মহিলার দিকে চেয়ে বললাম, আমি দেব আপনাকে?
হিরু গুপ্তর ক্রুদ্ধ দুচোখ আমার মুখের ওপর চড়াও হল–আপনার দরদ দেখাতে হবে না, সকলেরই দুটো হাত আছে সেটা ও সকালেই বুঝিয়ে দিয়েছে।
কথা-কাটাকাটির ভয়েই যেন মিলু মজুমদার তাড়াতাড়ি উঠল। একটি মাত্র বড় ডিশ নিয়ে খাবার তুলে নিল। আমাদের তুলনায় অতি সামান্যই নিল বলতে হবে। এত সামান্য যে চোখে পড়ে। আমি বললাম, ও কি, নিজে নেবার ফলে যে কিছুই নিলেন না!
অল্প হেসে জবাব দিল, আমি এর বেশি পারি না।
খেতে খেতে হিরু গুপ্ত তপ্ত ব্যঙ্গ ছুঁড়ল, অঢেল থাকলে তখন বেশি পারা যায় না, না থাকলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খেতে পেলেও বেশি হয় না।
মিলু হাসছে বটে! কিন্তু হাসিটা কেমন নিষ্প্রভ মনে হল আমার। –হিরু গুপ্ত বলেছিল সমস্ত সুখ আঁঝরা করে দিতে পারে, সেটা সত্যি মহিলা জানে মনে হল। তোয়াজের অভিব্যক্তিটুকু হয়তো সেই কারণে।
বিকেলের ভারী জলযোগ-পর্বেও হিরু গুপ্তর মেজাজ একটুও নরম দেখলাম না। কি হল ভেবে না পেয়ে মিলও যেন বিস্মিত একটু। তবে রাতের আহার-পর্বের সময় হিরু গুপ্তর রুক্ষ মুখ কিছু ঠাণ্ডা মনে হল। তেরছা সুরে সে জিজ্ঞাসা করল, আমার পরিবেশন চলবে, না অশুদ্ধ হবে?
হাসিমুখেই মিলুকে তাড়াতাড়ি মাথা নাড়তে দেখলাম। অর্থাৎ চলবে। হিরু গুপ্তর মেজাজের পরিবর্তন অন্য কারণেও হতে পারে। সে খাবার সাজাবার তোড়জোড় করার সঙ্গে সঙ্গে মজুমদার মশাই আস্ত মদের বোতল বার করেছেন একটা। ঈষৎ সঙ্কুচিত চোখে মিলু আমার দিকে তাকিয়েছে। আমার সহজ হবার চেষ্টা–এ যেন অস্বাভাবিক কিছুই না।
আমার চলে না শুনে মজুমদার মশাই দুই-একটা হালকা রসিকতা করলেন। তার পর নিজের গেলাসে বেশ খানিকটা মদ ঢেলে নিলেন। দ্বিতীয় গেলাসে ঢালার আগেই হিরু গুপ্ত বাধা দিল, আমি এখন না, শরীরটা ভালো লাগছে না।
-সে কি রে! ভালো লাগছে না বলেই তো এটা বার করলাম! সেই সকাল থেকে তোর যে রকম মেজাজ চলছে, খেলেই হালকা হয়ে যাবে, নে–
হিরু গুপ্ত বলল, তুমি খাও তো, আমার এখন ইচ্ছে করছে না, পরে দেখা যাবে। মজুমদার মশাই গোড়াতে একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন বোধহয়, কিন্তু গেলাসের তরল পদার্থ প্রথম দফায় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হৃষ্টচিত্ত। আর বিপুল আহার সহযোগে আধখানা বোতল খালি হয়ে যাবার পর স্বতঃস্ফুর্ত আনন্দে দুলছেন তিনি, অর্থাৎ সোজা হয়ে বসতেও পারছেন না।
রাতেও মিলুর সেই পরিচ্ছন্ন স্বল্পাহার লক্ষ্য করলাম। ঠিক দেখছি কিনা জানি না, তার মুখে একটু শংকার ছায়া। আড়চোখে এক এক বার দেওরকে দেখে নিচ্ছে। হিরু গুপ্ত গভীর মনোযোগে খেয়ে চলেছে।