–খাবে না তো আগে বললে না কেন?
তেমন মৃদু হাসি।–আগে তুমি জিজ্ঞাসা করেছ?
–আমাকে খাবার বার করতে দেখেও বললে না কেন?
–আচ্ছা আমারটা আমি রেখে আসছি।
–রেখে আসতে হবে না, তুমি খাবে কি খাবে না আমি জানতে চাই।
মিলু তার চোখে চোখ রেখেই আবার ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল– অর্থাৎ না। মজুমদার মশাই এতক্ষণ দেওর-ভাজের কথা-কাটাকাটি উপভোগ করছিলেন যেন। এবারে বললেন, আহা মিলু, ওকে রাগাচ্ছ কেন, যা হোক একটা তুলে নাও না!
বিরক্তি চাপতে চেষ্টা করে মিলু বলল, আমার এখন খাওয়ার ইচ্ছে নেই তবু জোর করছ কেন?
স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি হিরু গুপ্ত অপমান বোধ করছে। শেষবারের মতই জিজ্ঞাসা করল, তুমি খাবে না তাহলে?
তাকে জবাব দেবার বেলায় আবার হাসি-হাসি মুখ মিলুর। জবাব দিল না, মাথা নাড়ল– খাবে না।
সরোষে বড় ডিশটা নিজের দিকে টেনে নিল হিরু গুপ্ত। আমি ভাবলাম ওটা বুঝি এবার জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে! না, তার বদলে নিজে খাওয়া শুরু করল। ওর খাওয়ার এই একাগ্র ধরনটা আমি আগেও দেখেছি। আমাদের আগেই নিজের ভাগটা শেষ করল। পরে দ্বিতীয় ভাগটাও। আমি আর মজুমদার মশাই হাসছি। অল্প। অল্প হাসছে মিলু। হাসি নেই শুধু হিরু গুপ্তের মুখে।
খাওয়া শেষ করে তিনটে ডিশই একসঙ্গে করে কোণের দিকে সরিয়ে রাখল। অ্যাটেনডিং কারে চাকর আছে, স্টেশনে গাড়ি থামলে সে এসে ওগুলো পরিষ্কার করে রেখে যাবে। আমরা আগেই জল খেয়ে নিয়েছিলাম। হিরু গুপ্ত ঢক ঢক করে এক গেলাস জল খেয়ে পকেট থেকে সিগারেট বার করতে করতে দরজা খুলে করিডোরে চলে গেল। অর্থাৎ রাগ তার একটুও পড়েনি।
আমার দিকে ফিরে মজুমদার মশাই প্রসন্ন মন্তব্য করলেন, বেজায় চটেছে, ভয়ানক ভালবাসে তো–আর ও-ও ফাঁক পেলেই রাগাবে।
আড়চোখে রমণীর মুখখানা দেখে নিলাম। দুচোখ জানলা দিয়ে দূরের দিকে প্রসারিত।
সিগারেট একটু আধটু আমিও খাই। সেই অছিলায় বাইরে চলে এলাম। করিডোরে এসে দরজাটা আবার টেনে দিয়েছি।
বইরের দিকে চেয়ে হিরু গুপ্ত সিগারেট টানছে। আমার সিগারেট ধরাবার শব্দে একবার ফিরে তাকালো। গম্ভীর রাগ-রাগ মুখ।
বলে ফেললাম, আপনার হঠাৎ এত রাগের কি হল, ভদ্রমহিলার খিদে পায়নি তাই খেতে আপত্তি করেছেন।
ঠোঁটের সিগারেট হলদে দুই আঙুলের ফাঁকে উঠে এলো হিরু গুপ্তর। গোল দুটো চোখ আমার মুখের ওপর স্থির একটু। ক্রুদ্ধ চাপা স্বরে বলল, খিদের আসল চেহারাট আপনি জানেন? দেখেছেন কখনো?
মনে হল ইন্ধন যোগাতে পারলে হিরু গুপ্ত কিছু কথা বলতে পারে। কলকাতার। সেই হেঁটেলের পানভোজনের রাত থেকেই আমার মনে হয়েছে শোনানোর মত কিছু কথা হিরু গুপ্তর ঝুলিতে আছে। বোকা মুখ করে বললাম, সে আবার কি?
-আমি দেখেছি, বুঝলেন? তিন দিনে একদিন খাওয়া জোটে না, এই দুটো হাত ধরে বিবা মা আর মেয়ের সে কি আকৃতি–আমি গিয়ে না পড়লে খিদের জ্বালায়। ওই মেয়েকেই কটা হায়নার মুখে গিয়ে পড়তে হত খুব ভালো করে জানি–বুঝলেন?
সিগারেটে লম্বা অসহিষ্ণু দুটো টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে মন্তব্য করলে, আর এখন। তার এত অঢেল যে খিদে পায় না, যতসব ঢং–ওতে দাদা ভোলে, আমি ভুলি না!
একটু চেষ্টা করে মনে করতে হল।-হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
-সেদিন আপনার মেজাজ-পত্র ভালো ছিল না। খেতে খেতে কি একটা যন্ত্রণার। কথা বলহিলেন–আর বলছিলেন আপনার দাদার সেটা সব থেকে আনন্দের দিন আর সেই কারণেই ওটা আপনার সব থেকে খারাপ দিন।
গেল দুটো চোখ আমার মুখের উপর চক্কর খেল একপ্রস্থ। গাম্ভীর্য সত্ত্বেও অন্তরঙ্গ সুরেই বলল, আপনি খুব চতুর লোক, সেদিন বেমক্কা পেয়ে কথা বার করে নিয়েছেন।–সত্যি এক এক সময় এত যন্ত্রণা হয়!
বললাম, আত্মত্যাগের একটু-আধটু যন্ত্রণা আছেই।
শেষেরটুকু কানে গেলই না বোধ হয়, সাগ্রহে কাছে সরে এসে জিজ্ঞাসা করল, আমার আত্মত্যাগের কথা ও আপনাকে বলেছিলাম নাকি?
-না, অনুমান করেছিলাম।
-কই করেছিলেন। বড় একটা নিশ্বাস ফেলে সিগারেটের খোঁজে পকেটে হাত ঢোকালে
যুর জায়গায় মোচড় পড়তে এরপর হিরু গুপ্ত যা জানালো তার সারমর্ম, বিধবা আর তার মেয়ে মিলুকে সে আগেই জানত। হুগলীর দিকে থাকত তারা। মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালো আর খুব চালাক-চতুর। বরাবরই হিরু গুপ্তর ভালো লাগত। নেক দিনের ছাড়াছাড়ির পর আবার যখন দেখা, ওই মা-মেয়ের অচল অবস্থা। তখন, ওয়া জোটে না, পরনের কাপড় জোটে না। সময়ে সে গিয়ে না পড়লে আর পাঁচজনে ছিঁড়ে খেত ওই মেয়েকে, ওদের ঘর আঁস্তাকুড় হয়ে উঠত। হিরু গুপ্ত মিলুকে ছবিতে নামাবে ঠিক করে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল। মিলু সানন্দে রাজী হয়েছিল কালে দিনে এই মেয়ে নামী নায়িকা হতে পারত। আর তারপর বিয়েটাও সে-ই করত। কিন্তু সব ভণ্ডুল করল দাদা অর্থাৎ মজুমদার মশাই। মিলুকে একটা ভালো জায়গায় রাখা হয়েছিল আর তার সবে তখন ট্রেনিং চলছিল। দরাজ হাতে দাদাই খরচ যোগাচ্ছিল। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তার এমন মনে ধরে গেল যে মেয়েটাকে আর ছবিতে নামতেই দিল না। বিয়ের প্রস্তাব করল। হিরু গুপ্ত কত বড় আঘাত পেল সে-ই জানে–দাদার জন্যেই সব, দাদার জন্যেই যা-কিছু। নিজে ওদের বিয়ে দিল। মিলু প্রথমে রাজী হয়নি, শেষে অনেক বোঝাতে তবে রাজী।…