স্টেশনে আসা এবং ট্রেনে ওঠার পর থেকে এইটুকু সময়ের মধ্যেই আমার ভিতরে ভিতরে একটা নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্ত্রটির সঙ্গে মজুমদার মশই স্টেশনেই আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে এই অবকাশটুকুর মধ্যে আমার কেবলই মনে হয়েছে, সেই সন্ধ্যায় পানাসক্ত হিরু গুপ্ত যে যন্ত্রণার কথা বলেছিল সেটা এই রমণীর কারণে। হিরু গুপ্ত সেটা আভাসেও আমার কাছে ব্যক্ত করেনি, শুধু সেই সন্ধ্যার কিছু কথা মনে পড়েছে। এই যোগাযোগে তার বিরক্তি, গাম্ভীর্য আর পরোক্ষ মনোযোগ এই রমণীর প্রতি যেন বিশেষভাবে নিবিষ্ট দেখেছি। ট্রেন আসতে ব্যস্তসমস্তভাবে হাত ধরে মিলুকে গাড়িতে তুলতে দেখেছি। অথচ এই ব্যস্ততার কোন হেতু নেই। ওদের পিছনে আমি। কুলির মাল তোলা হলে মজুমদার মশাই ধীরেসুস্থে আসবেন বোধ হয়। সরু করিডোর ধরেও রমণীটিকে পিছন থেকে প্রায় আগলে নিয়ে এসেছে হিরু গুপ্ত। চোখের ভ্রম কিনা জানি না, এমনও মনে হয়েছে–কনুইয়ের মৃদু ধাক্কায় রমণী তাকে একটু ঠেলে সরাতে চেষ্টা করেছে আর তখন অস্ফুট স্বরে হিরু গুপ্ত গলা দিয়ে একটু ক্রুদ্ধ আওয়াজ বার করেছে। চলতি ট্রেনে জিনিসগুলো টুকটাক গুছিয়ে রাখার সময় ঝাঁকুনিতে রমণী দুই-একবার বেসামাল হয়েছিল, কিন্তু তাকে রক্ষা করার জন্য পিছনে হিরু গুপ্ত মজুত। সে তক্ষুণি তার দুই বাহুর ওপর দখল নিয়েছে। আর তারপর হিরু গুপ্তর বিরক্তিমাখা গম্ভীর চোখ কতবার যে ওই রমণীর মুখে এবং দেহে বিদ্ধ হতে দেখেছি ঠিক নেই। আমার ধারণা, পুরুষের এই চাউনি আমি চিনি। কিন্তু মজুমদার মশাই এ-সব সংশয়ের ধার-কাছ দিয়েও হাঁটেন মনে হয় না।
সিগারেট শেষ করে তেমনি অপ্রসন্ন মুখে তার জায়গায় এসে বসল। আপাতত তার জায়গা বলতে মিলুর পাশে। এদিকের বার্থে আমি আর মজুমদার মশাই। কথায় কথায় ছবির প্রসঙ্গ উঠল–অর্থাৎ যে ছবিতে মজুমদার মশাই হাত দিয়েছেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন হবে বলুন?
–আমি কি বলব!
–বাঃ আপনার গল্প, আপনি বলবেন না তো কে বলবে?
মহিলার দিকে ফিরে ঈষৎ আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, বইটা আপনি পড়েছেন?
মৃদু হেসে মিলু সামান্য মাথা নাড়ল। মজুমদার মশাই বলে উঠলেন, বা রে, এই গল্প সিলেকশনের পিছনে আসল ব্যাপারটাই তো আপনি জানেন না দেখছি! বই পড়ে ও-ই তো প্রথমে আমার পিছনে লাগে–এবারে এই গল্পটা করো। আপনার বই তো আমি আজও পড়িনি মশাই, তিনবার করে ওর মুখে গল্প শুনেছি।
লেখক মাত্রেরই ভালো লাগার কথা! ভালো লাগল। মিলুরও হাসি-হাসি মুখ। চকিতে হিরু গুপ্তর দিকে তাকালাম। তার অসহিষ্ণু বিরস বদন। কারণ আমার কাছে গল্প সিলেকশনের যে ফিরিস্তি সে দিয়েছে তার সঙ্গে এটা মিলছে না। চোখাচোখি হতে মর্যাদা রক্ষার তাগিদে ঠোঁটের ফাঁকে হঠাৎ একটু হাসি ঝুলিয়ে উঠে একেবারে আমার কানের সঙ্গে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ঠাকরোণকে দিয়ে কলকাঠিটি কে নেড়েছে দাদা সেটা জানলেও বলবে না। নিজের জায়গায় ফিরে গেল আবার। মিলুর চকিত চাউনি। মজুমদার মশাই ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি বললি শুনি?
হিরু গুপ্ত সাদাসাপটা জবাব দিল, বললাম, দাদা কার ক্রেডিট কাকে দিচ্ছে দেখুন! বউদির তোয়াজ করার সুযোগ পেলে তুমি ছাড়ো না!
মজুমদার মশাই সহাস্যে বললেন, তুই তো তোর বউদির কিছুই ভালো দেখিস না–এ গল্প কে আমার মাথায় ঢুকিয়েছে জেনেও লাগতে ছাড়বি না!
হিরু গুপ্তর হাসিটা তখনো ঠোঁটে ধরা আছে কিন্তু গলার স্বর একটু যেন অসহিষ্ণু।–তাহলে নাও গো, গল্পের ছবি কেমন হবে তুমিই লেখককে বলো।
নির্বাক মহিলার দুই চোখ অব্যাহতি চাইছে। হৃষ্টবদন মজুমদার মশাই বললেন, ও কি বলবে ছবি কেমন হবে না হবে! সে তো তোর ওপর নির্ভর করছে। আমার দিকে ফিরলেন–হিরু না থাকলে আমার ব্যবসা অচল আমিও অচল–সেটা জানে বলেই ওর এত দেমাক, বুঝলেন?
বার বার শাড়ির আঁচল টেনেটুনে বসাটা মহিলার একটা মিষ্টি অভ্যাস ভেবেছিলাম। এখন কেমন মনে হল, সেটা হিরু গুপ্তর ঘন-কটাক্ষ প্রতিহত করার দরুনও হতে পারে। মালিকের প্রশস্তি শুনে তার প্রসন্ন গম্ভীর তির্যক চাউনিটা রমণীর মুখের ওপর বিধে থাকল খানিক। আমার মনে হল, মিলু মজুমদারের ধড়ফড়ানি দেখলাম একটু।
হিরু গুপ্ত উঠে দাঁড়াল। মালিকের মন রক্ষার সুরে বলল, মুখ না চললে সত্যিই আর ভালো লাগছে না।
মজুমদার মশাই হাসলেন। ভাবখানা–আমি তো আগেই বলেছিলাম।
দুটো ছোট ডিশ আর একটা বড় ডিশে দুভাগ করে হিরু গুপ্ত শুকনো খাবার সাজালো। লোভনীয় সন্দেহ নেই। পেল্লাই সাইজের একটা করে চপ আর চিকেন কাটলেট, সঙ্গে মুখরোচক স্যালাড। ছোট ডিসের একটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, একটা মজুমদার মশাইয়ের দিকে। তারপর বড় থালার মত ডিশটা নিজেদের বেঞ্চের মাঝখানে রেখে রমণীর উদ্দেশে গম্ভীর রসিকতা করল, এসো–আমারটা নিয়ে টানাটানি কোরো না আবার!
সকলের চোখের ওপর বড় ডিশে দুজনের খাবারটা একসঙ্গে নেওয়া এমন কিছু দৃষ্টিকটু নয়, অথচ আমার ভালো লাগল না। ওদিকে রসিকতার জবাবে মিলু মজুমদার বলে ফেলল, আমি এখন খাবই না কিছু।
গলার স্বরটুকুও নিটোল মিষ্টি। কিন্তু এতেই হিরু গুপ্তের মেজাজ চড়ল, খাবে না মানে?
বিব্রত মুখে মিলু হাসতে চেষ্টা করল একটু।–খাব না মানে আবার কি—