অমায়িক একটু হেসে খাবারের প্রত্যাশায় আমি ঘাড় ফেরালাম। খাবার না আসা পর্যন্ত গেলাসের চাহিদা থামবে বলে মনে হয় না। খাওয়ার ফাঁকে হিরু গুপ্তর যন্ত্রণা প্রসঙ্গে পাড়ি দেবার ইচ্ছে।
গেলাস আধা-আধি খালি। সামনের দিকে ঝুঁকে সাগ্রহে সে এক ধরনের দার্শনিকতার মধ্যে ঢুকে পড়ল।–আপনি আজ টাকা পেলেন আপনার সুদিন, আর সমস্ত দিন উপোস আর ধকলের পর আপনাকে সেই টাকা দেবার জন্য ছুটতে হল বলে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেছল। ওদিকে দেখুন, দাদার আজ সব থেকে আনন্দের দিন আর ওই এক কারণে আজই আমার সব থেকে খারাপ দিন। একই কারণে একজনের ভালো তো একজনের খারাপ–একজনের খারাপ তো একজনের ভালো! আশ্চর্য না?
সদয় মুখ করে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।-আজকের দিনেই বোধহয় আপনি কাউকে খুইয়েছিলেন?
বেদনায় আর বিস্ময়ে হিরু গুপ্তের ভারী চোখ দুটো বিস্ফারিত।- আপনি তো অদ্ভুত মানুষ দেখি, আঁ! এমনিতে তো মনে হয়, ভাজা মাছখানা উল্টে খেতে জানেন না! সাগ্রহে আরও সামনে ঝুঁকল, গলার স্বর ভাঙা-ভাঙা।–কিন্তু এ যন্ত্রণার শেষ কোথায়? শেষ আছে?
–কি জানি!
–জানেন, জানেন–আপনি অনেক জানেন–বলুন।
ভেবে নিলাম একটু।–শুধু এইটুকু বলতে পারি, আপনার যন্ত্রণা যদি সত্যি হয়, তার একটা ভাগ তিনিও পাচ্ছেন।
নেশা ছোটার উপক্রম। লাফিয়ে উঠল যেন।–পাচ্ছেন? পাচ্ছেন? আপনি ঠিক জানেন?
ভারী গলায় জবাব দিলাম, তা নাহলে যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা থাকে না–বিস্বাদ হয়ে যায়।
কি বুঝল হিরু গুপ্ত সে-ই জানে। দুচোখ টান করে চেয়ে রইল।
খাবার এলো।
সেই খাবারের পরিমাণ দেখে আমার চক্ষুস্থির। এত অর্ডার দেওয়া হয়েছে কল্পনাও করিনি। প্রমাণ সাইজের টেবিলটায় হিরু গুপ্তর সোডার বোতল আর গেলাস রাখারও জায়গা নেই। এক চুমুকে সে গেলাসটা খালি করে দিল। টেবিল পরিষ্কার করে দুটো বয় আটটা বড় ডিসে একরাশ খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল।
হিরু গুপ্ত নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। ঘোর-লাগা দুই চোখ টান করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভোজ্যসামগ্রী একদফা নিরীক্ষণ করে নিল। তারপর কাঁটা-চামচে সব একধারে সরিয়ে রেখে হাত লাগালো। আমার উদ্দেশে অস্ফুট স্বরে বলল, শুরু করুন।
আমি শুরু করলাম কি করলাম না দেখার ফুরসত নেই। হিরু গুপ্ত ক্ষিপ্র মেজাজে খেতে লাগল। খাওয়ার ব্যাপারে এই গোছের তৎপর একাগ্রতা কমই দেখেছি। যেন অনেক দিন খেতে পায়নি। তার মধ্যে একরাশ খাবার হাতের কাছে পেয়ে হামহুম করে খেয়ে চলেছে। এই খাওয়ার ঝোঁক দেখে এতক্ষণ সে কোন রাজ্যে ছিল কল্পনাও করা যাবে না। মুখে কথা নেই, অবিরাম মুখ নড়ছে আর হাত নড়ছে। দুচোখ খাবারের ডিশগুলোর ওপরেই চক্কর খাচ্ছে। বলা বাহুল্য, মোট খাবারের চার ভাগের তিন ভাগই সে অক্লেশে উদরস্থ করল। এই খাওয়ার ফাঁকে দুই-একবার আমি পূর্ব প্রসঙ্গ উত্থাপনের চেষ্টায় ছিলাম, কিন্তু তার খাওয়ার তন্ময়তায় চিড় ধরানো গেল না।
একেবারে খাওয়া শেষ করে তবে মুখ তুলল। বড় একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, বেশ খেলাম, আপনার হয়েছে?
-অনেকক্ষণ।
–চলুন তাহলে ওঠা যাক।
বিল মিটিয়ে আবার তার গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। এখনো আশা করছিলাম হিরু গুপ্ত তার যন্ত্রণার প্রসঙ্গ তুলবে। কিন্তু সেটা ওই একরাশ খাবারের তলায় চাপা পড়ল কি আর কিছুর, ভেবে পেলাম না। কিন্তু যা-ই হোক, এই এক সন্ধ্যার পর থেকে হিরু গুপ্ত আমাকে একেবারে তার বুকের কাছের মানুষ ভাবে।
তৃতীয়, সহযাত্ৰিনী প্রসঙ্গ।
ভবঘুরের উক্তির সঙ্গে অনেকটা মেলে। রমণী শুধু সুদর্শনা নয়, সুলক্ষণাও। সুন্দর মুখে একধরনের চাপা মিষ্টি অভিব্যক্তি ছড়িয়ে আছে। মুখ তুলে সোজা মুখের দিকে তাকাতে পারে, কিন্তু চাউনিটা নরম আর ঠাণ্ডা গোছের। বয়েস বড়জোর তিরিশ, লম্বা গড়ন, স্বাস্থ্যও পরিমিত। নড়াচড়ার ফাঁকে নিজেকে একটু ঢেকেঢুকে রাখার সহজাত প্রবৃত্তিটুকুও মিষ্টি লাগল। পঁয়তাল্লিশ বছরের স্থলবপু মজুমদার মশাইয়ের পাশে একটুও মানায় না। কিন্তু সংসারের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ-রকম বেমানান জটিই দেখা যায়। নাম শুনলাম মিলু। মজুমদার মশাই এর মধ্যে বারকয়েক তাকে ওই নামেই ডেকেছেন। সম্ভবত সংক্ষিপ্ত আদরের ডাক এটা।
এক্ষুণি খাওয়ার প্রসঙ্গ বাতিল করে হিরু গুপ্ত তার সস্ত কড়া ব্র্যাণ্ডের সিগারেট বার করে ঠোঁটে ঝোলালো। তার পরেই একটু থমকে রমণীর দিকে তাকালো। রমণীর ঈষৎ অপ্রসন্ন ঠাণ্ডা চাউনি লক্ষ্য করলাম আমিও। এটুকুও সুচারু মনে হল। ১৬২
ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে হিরু গুপ্ত বলে উঠল, যাচ্ছি বাবা, বাইরে যাচ্ছি। এই জন্যেই নিজের জন্য আলাদা কম্পার্টমেন্ট করতে চেয়েছিলাম, এখন পনেরো মিষ্টি অন্তর উঠে বাইরে গিয়ে সিগারেট খেয়ে আসতে হবে
গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়াল সে। মজুমদার মশাইয়ের হাসিতে হে। ঝরল–তোরই তো দোষ, এতদিনে সিগারেটের গন্ধটাও সহ্য করাতে পারলি না–
প্রোডিউসার দাদার মুখের ওপর বেশ জুতসই সরস জবাব দিতে পারে দেখলাম হিরু গুপ্ত। বলল, দখলদার তুমি, আর সহ্য করানোর দায় আমার?–চেষ্টা করলে তোমার খুব ভালো লাগবে?
আমি বাইরের মানুষ সামনে বসে বলেই হয়তো রমণীর আরক্ত মুখ। মজুমদার মশাই জোরেই হেসে উঠলেন। মিলুর মুখের ওপর একটা বিরক্তিসূচক কটাক্ষ নিক্ষেপ করে সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে হিরু গুপ্ত দরজা টেনে করিডোরে চলে গেল।