শহর থেকে অনেক দূরে ছোট একটা ছিমছাম একতলা বাড়ি। সামনে ছোট একটু বাগান।
কড়া নাড়তে কাজলই দরজা খুলে দিল। তারপর দুই চক্ষু বিস্ফারিত। মুখে কথা সরে না খানিক।–কি ভাগ্যি কি ভাগ্যি–তোরা! আঁ, আমি জেগে আছি না ঘুমুচ্ছি? আয় আয় আয়
খুশিতে আটখানা একেবারে। আদর করে তাদের টেনে এনে বসালো। তারপর লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি শুরু করে দিল একেবারে।
গোড়ায় খানিক দুই বোনেরই বিব্রত মুখ। তারপর রমলা বলল, আর বেশি খাতির দেখাস না, বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনটে বছর-সোজা ভাবিয়েছিস?
কাজল হাসল একচোট। তারপর বলল, তিন বছর পরে তো আরো তিনটে বছর কেটে গেল, তার মধ্যে তো একটা-বার খবর নিতে এলি না!
শ্যামলী বলল, আমাদের আসা কি সহজ কথা নাকি, কোন রাজ্যের পারে এসে আছিস–তাছাড়া সেদিন মাত্র তো তোর ঠিকানা জানলাম।
কাজল হাসছে তাদের দিকে চেয়ে। ঝকঝকে দাঁতের একটু একটু দেখা যাচ্ছে। এমনিই নিঃশব্দ অথচ জীবন্ত হাসি রাজেন্দ্রাণীর ভূমিকায় নাটকেও দেখেছিল দুই বোনের মনে পড়ল। আর মনে হল মেয়েটার সেই চেহারা সেই রং সেই নাক মুখ চোখই আছে–কিন্তু তার মধ্যেই কেমন একটু শ্ৰী এসেছে বেশ যা চোখে পড়েই।
ফুর্তিতে কাজল নিজের হাতে চা বানালো, খাবার এনে সামনে রাখল, আর গল্প করতে লাগল। কিন্তু দিদিরা অন্য গল্প ছেড়ে শুধু সিনেমা আর থিয়েটার রাজ্যের গল্প শুনতে চায়। কাজলের ওই গল্পে আবার উৎসাহ কম, জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেয়।
অনেকক্ষণ বাদে ওর সিথির দিকে চোখ গেল রমলার। বলল, বিয়ে-থা করলি না এখনো, আর কবে করবি! বয়েস তো সাতাশ গড়ালো!
কাজল হাসিমুখে সোজা উত্তর দিল, বিয়ে করেছি বলতে পারিস, আবার করিওনি বলতে পারিস। তবে পাকা অনুষ্ঠান এবারে একটা শিগগিরই সেরে ফেলব ভাবছি…নেমন্তন্ন করলে আসবি?
আগেরটুকু শুনে রমলা আর শ্যামলীর মুখ লাল। কিন্তু জবাব দেবার আগেই বাইরে থেকে আর একজনের পদার্পণ ঘটল। সেই বাবরি-চুল সোনা ঘোষ, পরনে সেই রকমই পাজামা আর টুইলের শার্ট তবে একটু মোটার দিকে ঘেঁষেছে। ওকে দেখে বোনেরা সচকিত।
সোনা ঘোষ থমকালো একটু। তারপর একগাল হেসে বলল, দিদিরা যে! খবর ভালো?
রমলা আর শ্যামলী চুপ।
সোনা ঘোষ কাজলের দিকে ফিরল।–জলপাইগুড়ির সেই পার্টি ঠায় আপিসে বসে আছে, কন্ট্রাকট সই না করে নড়বেই না।
কাজল ভুরু কুঁচকে ভাবল একটু।–কবে নিতে চায়?
–এই মাসে হলেই সুবিধে হতো বলছে।
–উঁহু, এ মাসে হবে না, শুটিং আছে–সামনের মাসে গোড়ার দিকে হতে পারে। সব খরচখরচা বাদ দিয়ে চার হাজার টাকা দিতে রাজি থাকে তো কন্ট্রাকট সই করে। দাও।
দিদিদের দিকে আর একবার কৌতুক-মাখা চোখ বুলিয়ে সোনা ঘোষ চলে গেল। কাজল আলতো করে জিজ্ঞাসা করল, ভগ্নীপতি পছন্দ হল তোদের?
ওরা দুজনেই আঁতকে উঠল একেবারে। রমলা বলেই ফেলল, ওই লোফারটাকেই শেষ পর্যন্ত বিয়ে করবি তুই!
কাজল হাসছে। বলল, লোফারই বটে… গোড়ায় গোড়ায় অভিনয় রপ্ত করতে না পারলে চড়চাপড় পর্যন্ত বসিয়ে দিত, বুঝলি?
রাগত মুখে শ্যামলী বলল, তোর রুচি আর বদলালো না।
কাজল হাসছে।–যা বলেছিস, আর এত টাকাপয়সা নাড়াচাড়া করছে তবু রুচি ওই লোফারেরও বদলালো না!…অথচ কতই তো দেখছি, কত রকমের প্রস্তাব নিয়ে কত লোক আসছে–আর কত উদার সব! ভালো কথা, নিজস্ব প্রতিষ্ঠান করব খবরটা কাগজে বেরুবার পর চেকবই পকেটে করে বিমানদা আর রঞ্জনদাও ছোটাছুটি করে এসেছিল। কাজল হাসছে।–আলাদা আলাদা অবশ্য–টাকার দরকার নেই বোঝার পরেও আসার কামাই নেই–হাজার হেক, শালী তো–টান যাবে কোথায়! শেষে এত বেশি আসতে লাগল যে তোদের কথা ভেবে আমিই একদিন নিষেধ করে দিলাম–তোরা ফিরে গিয়ে বেচারাদের ওপর আবার রাগারাগি করিস না!
কাজল হাসছে। সেই সামান্য দাঁত-চিকানো নিঃশব্দ হাসি। এখন মেক-আপ নেই, পেন্ট নেই, তবু ওই মুখ ওই চাউনি আর ওই হাসি রাজেন্দ্রাণীর মতোই লাগছে।
রক্তশূন্য পাংশু বিবর্ণ মুখে মেলা ও শ্যামলী যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েও সেইটুকু দেখে নিচ্ছে।