দিদির ততদিনে একটি ছেলে হয়েছে, আর ছোটদিরও হব-হব করছে। স্বামীদের তারা আরো অনুগত হয়ে পড়েছে। নির্বাক কাজল বাড়িতে দুজনেরই গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্ব অনুভব করে। কাজলের সঙ্গে তারা যে একেবারে কথা বলে না তা নয়। দুভাই একসঙ্গে হলে ঠাট্টাও করে, আমাদের দুজনের মধ্যে সেই ভাগাভাগিই হল দেখছি
বিমানদা জিজ্ঞাসা করে, পড়াশুনার ইচ্ছে থাকে তো বলো, আবার ব্যবস্থা করে। দিই!
দিদি উষ্ণ ঝুঁজ দেখায়, আর পড়াশুনায় কাজ নেই, বিয়ের চেষ্টা দেখো।
রঞ্জন সকলের সামনেই জ্ব-ভঙ্গি করে খুঁটিয়ে দেখে কাজলকে।–তোমরা যা-ই বলো, কাজল দেবীর মধ্যে একটা বলিষ্ঠ ভাব আছে যা তোমাদের নেই ছেলেগুলোর চোখে পড়ে না কেন বুঝি না।
শ্যামলী হেসে বলে, তোমাকে আর চাটুকারিতা করতে হবে না!
দুই ভাইয়ের খুব ভাব। তারা একত্র হলেই শুধু এই গোছের একটু-আধটু হাসি-ঠাট্টা হয়।
এরই মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটে গেল একদিন। কাজল তখন রমলার কাছে। বাড়ির ঝি এসে জানালো, একটা লোক মাসিমণির খোঁজ করছে।
মাসিমণি অর্থাৎ কাজল। বিমান কাজে বেরোয়নি তখনো। সেও শুনল খবরটা। রমলা আর বিমান দুজনেই দরজার বাইরে এসে দেখল কে লোক। দেখামাত্র রমলা চাপা ঝাজে বলে উঠল, তাড়িয়ে দাও! ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দাও!
অদূরে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাবরি-চুল সোনা ঘোষ।
কিন্তু তাড়ানো বা ঘাড়ধাক্কা দেওয়ার ফুরসত মিলল না। ওদিকের ঘর থেকে তাকে দেখেই কাজল পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছে। সামনে এসে দাঁড়াল। পাঁচ সাত মিনিট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দুজনের কি কথা হল এদিকের কেউ জানল না। রমলা আর বিমান লোকটাকে বিমর্ষ মুখে চলে যেতে দেখল।
বিমান জিজ্ঞাসা করল, কে?
রমলা শুকনো গলায় জবাব দিল, সোনা ঘোষ… বাজে লোক একটা।
–কি করে?
–থিয়েটার।
লোকটা চোখের আড়াল হতেই রাগে গজরাতে গজরাতে বোনের কাছে এলো রমলা।-ও এখানে এসেছে কোন সাহসে? কোন আক্কেলে?
কাজল মুখ তুলে তার দিকে তাকালো শুধু। দিদির পিছনে বিমানদা দাঁড়িয়ে।
দিদি আরো অসহিষ্ণু।–আমি জানতে চাই, ও কেন এসেছে এখানে?
কাজল ঠাণ্ডা জবাব দিল, আমাকে দেখতে।
এরকম জবাব পাবে রমলা আশা করেনি। রাগে সমস্ত মুখ রক্তবর্ণ। কিন্তু সে ফেটে পড়ার আগেই বিমান জিজ্ঞাসা করল, তোমাকে দেখতে ও কি আরো এখানে এসেছে, না এই প্রথম?–
কাজল নিরুত্তরে তাকাল শুধু। জবাব দিল না।
-দেখো কাজল দেবী, বিমানের গলার স্বর আদৌ উঁচু পর্দায় উঠল না, অথচ কঠিন শোনালো, এ বাড়ির ডিসিপ্লিন আর রীতিনীতি একটু অন্যরকম, সেটা এতদিনে তোমার বোঝার কথা–এটা মনে রেখো।
বিকেলেই ফোন করে শ্যামলীকে আনিয়েছে রমলা। ওদিকে বিমানের মুখে রঞ্জনও খবর শুনছে। আপিসের পর সেও সোজা এখানেই এসেছে। আর তারপর সকলে মিলে কঠিন উপদেশই দিয়েছে কাজলকে।
কাজল নির্বাক। সে-ও তার একটা বাড়তি অপরাধ যেন। আসলে সে যে সোনা ঘোষকে এখানে আসতে সাফ নিষেধ করে দিয়েছে, সেটা জানার কেউ দরকার বোধ করল না।
পরদিন দিবানিদ্রা সম্পন্ন করে রমলা কাজলকে দেখতে পেল না। কোথাও না। শ্যামলীকে ফোন করল। সেও আকাশ থেকে পড়ল, অর্থাৎ তার ওখানেও যায় নি।
দুই-এক দিন নয়, দুই-এক মাস নয়–টানা তিন বছর কেউ আর তার হদিস পেল না।
.
কোনো এক অ্যামেচার ক্লাবের অভিনেত্রী কাজল মিত্রর নাম ছড়াতে লাগল একটু একটু করে। তারপর সে-নাম আর দিদিদের ভগ্নীপতিদের কানেও এলো। তারা সাগ্রহে দুই একটা থিয়েটার দেখে এলো। অভিনয় সকলেরই ভালো লেগেছে, কিন্তু সকলেই গম্ভীর।
বোনেরা খবর সংগ্রহে সচেষ্ট হল।… অ্যামেচার ক্লাবের অভিনেত্রী হলেও ভালো রোজগার করে কাজল মিত্র। কলকাতা এবং কলকাতার বাইরে থেকেও ডাক পড়ে তার।
আরো এক বছরের মধ্যে ওই নামের চটক চারগুণ বেড়ে গেল। সিনেমা থিয়েটারের পত্র-পত্রিকায় তার ছবি আর খবর বেরুতে লাগল। বড় কাগজের কলা বিভাগগুলোতেও। শহরে সব থেকে বড় পেশাদার নাট-মঞ্চ মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দু-বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ করেছে তাকে।
সেই দু বছরে তার তিনটে নাটকের সফল অভিনয় খেল দিদি-ভগ্নীপতিরা। মুগ্ধ হবার মতোই অভিনয় বটে। পেন্টিংয়ের ফলে স্টেজে দমতো রূপসী দেখায়। তাকে। মাঝের ঐতিহাসিক এক নাটকে তো রাজেন্দ্রাণীর ভূমিকায় তারই জয়জয়কার। সেই অভিনয় দেখেও দিদিরা হতবাক। হাবভাব চাউনি চলন বলন সবই মিষ্টি অথচ দৃপ্ত রাজেন্দ্রাণীর মতোই।
তৃতীয় বছরের শেষেই পত্র-পত্রিকার বিমর্ষ খবর, প্রতিভাসম্পন্না অভিনেত্রী কাজল মিত্রকে পেশাদার নাটমঞ্চ আর চুক্তিবদ্ধ রাখতে সক্ষম হলেন না। অচিরে নিজেই তিনি একটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান চালু করবেন। ইতিমধ্যে চিত্রজগতের দুজন খ্যাতিমান। পরিচালক তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। দুটি বড় ছবিতে কে নায়িকার ভূমিকায় দেখা যাবে। তবে আশার কথা, কাগজের প্রতিনিধিদের তিনি বলেছেন, রঙ্গমঞ্চই তার প্রাণ, এটি তিনি ছাড়বেন না, ছায়াচিত্রের কাজটাই বরং সাময়িক।
ছোট বড় সব কাগজেই চিত্র এবং নাটমঞ্চের পাতায় কাজল মিত্রর ছবির ছড়াছড়ি। কাজল মিত্র গাড়ি ড্রাইভ করছেন। নীল চশমা পরে-কাগজে এমন ছবিও বেরিয়েছে। আর কাজল মিত্রর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান চালু হবার সংবাদও।
আর নিস্পৃহ থাকা সম্ভব হল না দুই বোনের। পরামর্শ করে এক দুপুরে বাড়ির গাড়ি না নিয়ে ট্যাকসিতে চেপে দুজনে বেরিয়ে পড়ল। সিনেমার কাগজে বাড়ির ঠিকানার হদিস মিলেছে–কিন্তু গাইড হাতড়ে ফোননম্বর পায়নি। অতএব কপাল ঠুকে রওনা হয়েছে।