তার দিকে চেয়ে আমি অবাক একটু। শুকনো ক্লান্ত মুখ, উসকো-খুসকো চুল। এসেই টাকার বাণ্ডিল সামনে ফেলে দিয়ে রিসিট বার করে বলল, দেখে নিয়ে সই করে দিন
দেখে নেওয়া অর্থাৎ টাকা গুনে নেওয়া দরকার বোধ করলাম না। যারা দিচ্ছে দেখেশুনে গুনেই দিচ্ছে। রিসিটটা নাড়াচাড়া করতে করতে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাকে ভালো দেখাচ্ছে না, অসুস্থ নাকি?
-না মশাই, এই লোহা-মার্কা শরীরে অসুখ-বিসুখ নেই–সেই সকাল থেকে আপনার এই ছবির ব্যাপারে ছোটাছুটি, তারপর তিনটে থেকে ছটা পর্যন্ত ইনকাম ট্যাক্স, সেখান থেকে ডিরেক্টরের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেরে আপনার এখানে আসছি –সকাল থেকে চান দূরে থাক পেটে একটা দানা পড়েনি।
আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।সে কি! নিজে না এসে বাদাকে পাঠালেই তো পারতেন!
হাসল। হাসিটা কেমন তিক্ত মনে হল আমার। জবাব দিল, তিনি আজ ব্যস্ত বড়, তাঁর ব্যস্ততার সবটুকুই আনন্দের। নিন সই করুন চটপট
রিসিট রেখে টাকার বাণ্ডিল হাতে করে আমি উঠে দাঁড়ালাম। সই পরে হবে, আপনি ঠাণ্ডা হয়ে বসুন, বিশ মিনিটের মধ্যেই আমি আপনার খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
এই আন্তরিকতার ফলে উল্টে কেউ যে বিরক্ত হতে পারে ধারণা ছিল না। হিরু গুপ্ত যথার্থই বিরক্ত। উঠে দাঁড়াল একেবারে।- দেখুন মশাই, আমার মেজাজপত্র এখন ভাল নয়, সই করবেন তো করুন, নইলে আমি চললাম, পরে সই করে পাঠিয়ে দেবেন।
মেজাজ দেখে সত্যিই বিব্রত বোধ করলাম একটু। বসে রিসিট সই করে দিলাম। সেটা দেবার ছলে তার হাত ধরে সকাতরে বললাম, দেখুন সমস্ত দিন উপোস করে আপনি টাকা দিতে এসে শুধু-মুখে ফিরে গেলে খুব খারাপ লাগবে, আপনি দশটা। মিনিট বসুন, আমি যা হোক কিছু ব্যবস্থা করছি।
বিরক্তি চাপতে চেষ্টা করে সোজা মুখের দিকে তাকালো। তারপর কি ভেবে থমকালো একটু।–খাওয়াতে চান?
–যা হোক একটু কিছু
–একটু কিছু কি খাওয়াবেন?
–একটু সময় দিলে যা খেতে চাইবেন তাই খাওয়াব।
হাতঘড়িটা দেখে নিল। সাড়ে সাতটা। আবার চোখে চোখ রেখে দুই এক পলক ভেবে নিল। তারপর কষ্ট করে হেসে বলল, সমস্ত দিন বাদে একটু কিছু খেয়ে আর কি হবে, আজ আপনার সুদিন, খাওয়াতে চান তো ভালো করেই খাওয়াবেন চলুন, আমি গাড়িতে বসছি, চটপট রেডি হয়ে আসুন।
আমি হতভম্ব একটু। হিরু গুপ্ত ততক্ষণে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে। অগত্যা। তাড়াতাড়ি ভিতরে এসে জামাকাপড় বদলে নিলাম। কি খেতে চায় ভগবানই জানেন। নোটের বাণ্ডিল থেকে দুটো একশো টাকার নোট পকেটে ফেলে বেরিয়ে এলাম। স্ত্রী ততক্ষণে খুশিচিত্তে নোটের তাড়া নিয়ে গুনতে বসেছেন।– যা মনে হয়েছিল তাই। গাড়িতে পাঁচটা কথাও হল না, অভিজাত এলাকায় এসে যে ভোজনশালাটি বেছে নিল সেটি পানশালাও বটে। আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। হিরু গুপ্ত ড্রিংক-এর অর্ডার পেশ করল। আমার চলে না শুনে একটু যেন বিরক্ত। বেয়ারা চলে যেতে মন্তব্য করল, আপনি একেবারে জলো লেখক দেখি
নিঃশব্দে দুদফা গেলাস খালি করল। ইশারায় বয়কে আবার ঢেলে দিতে বলল। ইতিমধ্যে খাবার অর্ডারও সে-ই দিয়েছে। এতক্ষণে একটু একটু করে মেজাজ আসছে। মনে হল। মুখে সস্তা কড়া সিগারেট লেগেই আছে। ঘন ঘন সিগারেট খাওয়াটাও রোগ হিরু গুপ্তর। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, মদ কেন খাই বলুন তো?
-অভ্যেস করে ফেলেছেন!
-কেন অভ্যাস করতে গেলাম? ভালো জিনিস তো কিছু নয়। এই যে আমি একাই গিলে চলেছি, সামনে বসে আপনি খাচ্ছেন না–আপনার ওপর আমার রাগই হচ্ছে।
জবাব এড়াতে চেষ্টা করে বোকার মত একটু হাসলাম শুধু। চো করে হিরু গুপ্ত গ্লাসের অর্ধেক সাবাড় করল। সিগারেটের ডগায় নতুন সিগারেট ধরিয়ে বলল, আসলে যন্ত্রণা ডোবাবার এ একটা মোক্ষম দাওয়াই। আমিও খেতাম না, এখন এন্তার খাই। শালারা খাবার দিতে এত দেরি করেছ কেন? কি বলছিলাম, যন্ত্রণা! আপনি আমার। সঙ্গে পনেরো দিন এসব জায়গায় ঘুরুন, তারপর বাড়ি ফিরে একদিন দেখুন অন্য কোন লোকের সঙ্গে আপনার বউ পালিয়েছে বা সেই গোছের কিছু একটা হয়েছে। –তখন দেখবেন মদ আপনার একমাত্র বন্ধু। হেসে উঠল, এটা একটা কথার কথা, মানে উপমা
হিরু গুপ্ত এখন কথার মুড-এ আছে। আর এক চুমুকে গেলাস খালি করে হাঁক দিল, বোয়!
হন্তদন্ত হয়ে এসে বয় গেলাস বদলে সোডার বোতল খুলে সামনে রাখল। তার। দিকে চেয়ে হিরু গুপ্ত নৃশংস অথচ ঠাণ্ডা গলায় বলল, পাঁচ মিনিটমে টেবিল পর। খানা নহী আয়ে- তো
বাকিটুকু শেষ করে পাঁচ আঙুলে খোলা সোডার বোতলটা চেপে ধরল সে। এখানকার বয় সম্ভবত খদ্দেরের এই গোছের মেজাজ দেখে অভ্যস্ত। গলা দিয়ে জি সাব নির্গত করে চকিতে উধাও সে। হিরু গুপ্ত গেলাসে সোডা মেশালো। এইবার আমি আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়লাম। বললাম, আপনার যন্ত্রণাও মেয়েঘটিত নিশ্চয়ই!
গেলাস মুখে তুলতে গিয়েও তোলা হল না। হিরু গুপ্ত আকাশ থেকে পড়ল যেন একেবারে।–আমার যন্ত্রণার কথা আপনি জানলেন কি করে? আমি কিছু বলেছি?
নেশার ঘোরে আলোচনার প্রসঙ্গ এরই মধ্যে ভুলেছে মনে হল। আমার সুবিধেই হল, বললাম, আপনাকে দেখে কেন যেন আমার সেই রকমই মনে হয়।
–কি মনে হয়? উদগ্রীব।
–কোন মেয়ের কাছ থেকে আপনি বড় রকমের আঘাত পেয়েছেন।
থমথমে চোখে মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। তারপর বড় করে এক টোক গিলে নিয়ে বলল, এই জন্যেই আপনারা লেখক, আপনারা জীবনশিল্পী–আপনার। সম্পর্কে আমার ধারণাই বদলে গেল।