যাক, কাজলকে নিয়েই এ বাড়ির যা-কিছু অশান্তির সূত্রপাত। দুদুটো মেয়ের অত ভালো বিয়ে হওয়ায় বাবা-মায়ের ওর জন্য আরো বেশি দুশ্চিন্তা। কিন্তু আচার আচরণে মেয়ে যেন আক্রোশবশতই তাদের দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে চলেছে।
…একদিন দুপুরে বাপেরবাড়ি আসার সময় রমলা দেখে মোড়ের ও-ধারে একটা বাবরি-চুল লোকের সঙ্গে কাজল হেসে হেসে কথা কইছে। লোকটাকে এরা সকলেই চেনে। নাম সনৎ ঘোষ, সকলে সোনা ঘোষ বলে ডাকে। কোন এক অ্যামেচার ক্লাবের হয়ে থিয়েটার করে বেড়ায়। সেই থিয়েটারও রমলারা দুই-একটা দেখেছে। টাইপ রোল-এ মন্দ করে না অবশ্য, কিন্তু রমলারা দুচক্ষে দেখতে পারে না ওকে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকত–আর হরদম বিড়ি টানত।
সিনেমা থিয়েটার দেখার ব্যাপারে তিন বোনের মধ্যে কাজলেরই নেশা বেশি। তা বলে এরকম একটা লোকের সঙ্গে তার বোন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলবে, হাসাহাসি করবে!
পিত্তি জ্বলে গেল. রমলার। এসেই মাকে নিয়ে পড়ল। ড্রাইভারও নাকি দেখেছে। আর তাইতে লজ্জায় আরো বেশি মাথা কাটা গেছে রমলার।
মায়ের বুকে ত্রাস। বললেন, ও আমাদের মুখ পুড়িয়ে ছাড়বে, তোরা কিছু বল
কাজল বাড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি, বকাবকি। কাজল ব্যাপারখানা বুঝে নিল। সরোষে একবার দিদির দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। কিন্তু রমলা ছাড়বার পাত্র নয়। ঘরে ধাওয়া করল। বি, এ, পড়ছিস আর এই রুচি তোর, অ্যাঁ? এ-রকম একটা থার্ডক্লাস লোকের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলিস, হাসাহাসি করিস?
কাজল গম্ভীর শ্লেষে জবাব দিল, তোদের মতো ফার্স্টক্লাস লোক আর কোথায় পাব ব–আমার জুটলে থার্ডক্লাসই জুটবে!
রমলা ঝলসে উঠল, লজ্জাও করে না মুখ নেড়ে কথা বলতে! তোর জামাইবাবু যদি কোন দিন এই কাণ্ড দেখে, কক্ষণো কোথাও তোর জন্যে চেষ্টা করতে রাজি হবে?
সঙ্গে সঙ্গে কাজলের ধৈর্য গেল। পাল্টা ঝাজে বলে উঠল, তুই আর তোর বরও এই কাণ্ড করে উতরে গেছিসতোদের বেলায় দোষ নেই কেন? গায়ের চামড়া সাদা বলে আর বিমানদার টাকা আছে বলে?
রমলা চিৎকার করে উঠেছে, মা–কাজল আমাকে অপমান করছে, আমি আর এ বাড়িতে আসব না বলে দিলাম কিন্তু!
মা আঁ-হাঁ করে ছুটে এলেন, আর তারপর যা মুখে আসে তাই বলে কাজলকে আর একপ্রস্থ গালাগালি।
মাসখানেকের মধ্যে এর থেকে দ্বিগুণ হুলুস্থুল বাড়িতে। ছুটির দিনে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে বিমান আর রঞ্জন সস্ত্রীক সিনেমা দেখতে গেছল। হাফটাইমের আলো জ্বলতে রঞ্জনের চোখে পড়ল, সামনের সস্তার টিকিটের সারিতে একটা লোকের পাশে বসে আছে কাজল। দুজনে হাসছে, গল্প করছে। গায়ে খোঁচা মেরে শ্যামলীকে দেখালো রঞ্জন, শ্যামলী দিদির গা-টিপে সামনের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ফলে বিমানেরও দেখতে বাকি থাকল না।
চারজনেই সারাক্ষণ গম্ভীর তারপর। রমলা আর শ্যামলীর ছবি দেখা মাথায় উঠল। সোনী ঘোষকে ওরা দুজনেই চেনে। কিন্তু বিমান আর রঞ্জন জিজ্ঞাসা করতে দুজনেই মাথা নেড়েছে–চেনে না।
শো ভাঙার পর বিমান আর রঞ্জনের ছোট শালীর জন্য অপেক্ষা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রমলা আর শ্যামলীর এত মাথা ধরেছে যে তারা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারছে না। ব্যাপার বুঝেই দুভাই আর গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করল না। বাড়ি ফিরে। ছোট শালীকে নিয়ে গম্ভীর টিকাটিপ্পনী শুরু করল।
রাত্রিতে একসঙ্গে দুবোনই বাপেরবাড়ি এসে হাজির। বাবাও বাড়িতে তখন। সমাচার শুনে বাবা-মায়ের মাথায় বজ্রাঘাত। তার ওপর রমলা শ্যামলী স্পষ্ট জানিয়ে দিল, এ রকম বিচ্ছিরি ব্যাপার হতে থাকলে তাদের আর বাপেরবাড়ি আসতেই দেবে না।
ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে পায়ের থেকে চটি খুলে ছোট মেয়েকে মারতে গেছলেন। বাবা। মেয়েরাই অবশ্য আটকেছে। আর মা আঁশবটি দিয়ে কুটতে চেয়েছেন তাকে। ঘেন্নায় ওই আঁস্তাকুড়-মার্কা মুখে থুথু ছিটোতে চেয়েছেন।
বিমান আর রঞ্জন বাড়ি এলে কাজল এরপর নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করেছে। তারা ডাকা সত্ত্বেও আসেনি। দিদিরা তার ফলেও ভয়ানক অপমান বোধ করেছে।
বাপেরবাড়ির এই অশান্তির সংসারে দুর্দিন ঘনালো হঠাৎ। বলা নেই, কওয়া নেই, হার্ট-অ্যাটাকে মা হঠাৎ চোখ বুজলেন। বোনেরা তারস্বরে আক্ষেপ করল, কাজলই মা-কে মেরে ফেলল।
পাঁচ মাস না যেতে বাবাও গাড়িচাপা পড়ে মায়ের পথ ধরলেন। বড় দুই বোন। এবারেও আছাড়ি-বিছাড়ি করে কাঁদল। সেই একই আক্ষেপ। ছোট বোনের চিন্তাতেই বাবা অহরহ অন্যমনস্ক থাকতেন। অতএব এই মৃত্যুর জন্যেও সে-ই দায়ী।
শোকের ব্যাপার চুকেবুকে যেতে ওই দিদিদের আশ্রয়েই আসতে হল কাজলকে। কর্তব্যবোধে দিদিরাই টেনে নিয়ে এল অবশ্য। কিছুদিন বড়দি রাখল তাকে, কিছুদিন ছোটদি। ওর অবস্থানের ফলে দুই দিদিই স্বামীদের কাছে সংকুচিত। সর্বদাই চাল-চলন সম্পর্কে উপদেশ দেয় বোনকে। আর মেজাজ বুঝে বোনের বিয়ের চেষ্টার অনুরোধ জানায়।
তারা কখনো চুপ করে থাকে, কখনো বিরক্ত হয়। বলে, সবুর করো, চেষ্টা হচ্ছে, বললেই তো আর বিয়ে হয় না-বোনের রূপ তো জানো!
পাশের ঘর থেকে বিমানদার এই কথা নিজের কানে শুনেছে কাজল। তার ধারণা, রঞ্জনদাও ছোড়দিকে এই কথাই বলে।