ব্যাপার দেখে মেয়েদের বাবা-মা ভেবাচাকা। তাই দেখে আড়াল থেকে শ্যামলী আর কাজল মিটিমিটি হাসে। রমলা ওদের চোখ পাকিয়ে ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ খবরদার, বাবা-মাকে কিছু বলবি না!
কিছু না বললেও তাঁরা আঁচ করে নিলেন। শ্যামলী আর কাজল ছমাস আগে থেকেই বাবা-মায়ের মুখে এই হাসি দেখার প্রত্যাশায় ছিল। একই প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে আর একই বিল্ডিংয়ের দুই শাখার একদিকে কলেজ, একদিকে স্কুল। বাড়ি এসে এই দুই মেয়েকে দিদি কেন ফিরল না সে-সাফাই অনেক দিন গাইতে হয়েছে বাবা-মায়ের কাছে। বি, এ, পরীক্ষা আসছে, পড়ার চাপ বাড়ছে, দিদি বিনেপয়সায় ছুটির পর প্রোফেসারদের বাড়ি পড়তে যায়, কখনো বা স্পেশাল টিউটোরিয়ালের জন্য কলেজেই আটকে যায়, ইত্যাদি। মেয়ে কলেজ, মেয়ে প্রফেসার, অতএব বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। বড় মেয়ের হঠাৎ পড়াশুনার একাগ্রতা দেখে মনে মনে বরং খুশিই। তাঁরা। সেই মেয়ে বিয়ের পরেই কলেজের সঙ্গে সম্পর্ক হেঁটে দিল সেটাই বিস্ময়। মা বলেছিলেন এত পড়াশুনা করলি, এত কষ্ট করলি, পরীক্ষাটা দিয়েই ফেল না!
রমলা বলেছে, ভালো লাগে না।
বড় মেয়ের ভালো লাগা-না-লাগাটা বাবা-মা এখন আর ছোট করে দেখেন না। মা বলেন থাক তা হলে।
কাজল একটু ঝামটা মেরে বলে বসেছিল, কষ্টের ফল তো পেয়েই গেছে, আবার কেন!
শ্যামলী সশঙ্ক দৃষ্টিতে ভেঁপো বোনের দিকে তাকিয়েছে। সে ইদানীং দিদিকে বেশ একটু তোয়াজ তোষামোদ করে। রমলা ছোটর কাছেও তা-ই আশা করে। আড়ালে টেনে এনে কাজলকে শাসিয়েছে, তোর বড় বাড় বেড়েছে, না?
কাজলেরও তেমনি জবাব, যা যা, ওই ছোড়দি তোকে পটে বসিয়ে হাতজোড় করে থাকবেখন, আমাকে চোখ দেখাতে আসিস না!
চার মাস না যেতে কাজল মায়ের কাছে আর একটা বোস উক্তি করে ফেলেছিল। বলেছিল, ছোড়দিরও শিগগিরই খুব ভালো বিয়ে হয়ে যাবে দেখো!
মায়ের মনে সংশয়, চোখে ভয়।-তুই কি করে জানলি?
–দেখে নিও। কাজল আর বিস্তারের ধার ধারে না।
সেই বিকেলেই শ্যামলী একেবারে আগুন ওর ওপর।-মাকে বলতে গেলি, তোর লজ্জা করে না, হিংসুটে কোথাকার! ভিতরটাও হিংসেয় একেবারে কালি হয়ে আছে, কেমন?
কাজল পাল্টা রুখে উঠেছে, আছেই তো। বেশ করেছি বলেছি–আমি বাইরে কালো, ভিতরে কালো, আমার সব কালো। তুই তোর ভদ্রলোককে রূপ ধুয়ে জল খাওয়াগে যা।
আরো মাসকয়েক যেতেই ছোট মেয়ের উক্তির সার বুঝতে কষ্ট হয়নি মায়ের। রমলা প্রায়ই শ্যামলীকে নিজের বাড়িতে ধরে নিয়ে যায়। ছুটি থাকলে দুই-এক দিন আটকেও রাখে। ছোট বোনের চেহারা যেমনই হোক, তাকে অবজ্ঞা করতে দেখে। মায়ের মনে লাগত। কিন্তু বড় মেয়ের আসল উদ্দেশ্যটা বোঝা গেল যখন মাঝে। মাঝে ওর খুড়শ্বশুরের ছেলের এ-বাড়িতে পদার্পণ ঘটতে লাগল। শ্বশুর আর খুড় শ্বশুরের যুক্ত ব্যবসা, তবে একান্নবর্তী পরিবার নয়। জামাই বিমানের মতো, রঞ্জনও ওই ব্যবসার পদস্থ লোক একজন। সেও সুশ্রী, শিক্ষিত-বিমানের থেকে আট-নমাসের
রমলার কাছে সৌভাগ্যের আভাস পেয়ে আশায় আনন্দে মুখে কথা সরে না। মায়ের। মনে মনে বড় মেয়ের বুদ্ধির কত যে প্রশংসা করেছেন তারপর ঠিক নেই।
না, আশা এবং আনন্দ ব্যর্থ হয়নি মায়ের। রঞ্জনের সঙ্গে শ্যামলীরও নির্বিঘ্নে বিয়ে হয়ে গেছে। আনন্দের হাট একেবারে।
তিন মাস না যেতে মা এবার দুই কৃতী জামাইকেই মুরুব্বি ধরেছেন। ছোটর জন্য এবারে একটা ভালো ছেলে দেখে দাও বাবারা–চেহারা যেমনই হোক, তোমরা থাকতে ওর বিয়ে হবে না?
কাজল মায়ের ওপর রাগে জ্বলছে। বিমান আর রঞ্জন দুজনেই শাশুড়ীকে আশ্বাস দিয়েছে–বিয়ে হবে না কেন, সবে তো হায়ার সেকেণ্ডারি দিল–এত ব্যস্ত হচ্ছেন। কেন?
শাশুড়ী আড়াল হতেই প্রায় সমবয়সী খুড়তুতো-জাঠতুতো দুই ভাই কাজলের পিছনে লেগেছে। বিমান বলে, হারে রমা, আর তো হাতের মুঠোয় ভাই-টাই নেই আমাদের–এটাকে আমরাই ভাগাভাগি করে নিয়ে নিই, কি বলিস?
রঞ্জন সায় দেয়, আপত্তি কি, মা যে কেন ওর চেহারার খোঁটা দেন বুঝি না–আমার তো বেশ লাগে।
কাজল ভেঙচি কেটে চেঁচিয়ে জবাব দেয়, নিজের নিজের বউকে শো কেস-এ সাজিয়ে রেখে দেখে দেখে চোখ জুড়োও গে যাও না–আমার পিছনে কেন!
এমন গলা ছেড়ে এই গোছের কথা বলে যে দু ভাই-ই চুপ করে যায়। দুবোন ভ্রূকুটি করে তাকায় ছোট বোনের দিকে। ওকে আড়ালে ডেকে ধমকায়, তোকে পছন্দ করে বলেই ও-রকম ঠাট্টা করে, তা বলে তুই যা মুখে আসে তাই বলবি! বাড়িতে সক্কলে কত সমীহ করে ওদের, জানিস?
-তোরা যে যার পাদোদক ধুয়ে জল খা গে যা, আমার পিছনে লাগতে আসে কেন?
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে কাজল অনেক সময় অবাক হয়েছে। বিয়ের আগে পর্যন্ত যে দুভাই হ্যাংলার মতো দিদিদের পিছনে ঘুরেছে, কলেজে এসে হাজির হয়েছে বেহায়ার মতো, চোরের মত লুকিয়ে সিনেমায় নিয়ে গেছে–বিয়ের কিছুদিন না যেতে সেই মানুষদের ভিন্ন মূর্তি-রাশভারী হোমরা-চোমরা মানুষের মতো হাব-ভাব। দিদির না হয় দেড় বছর হতে চলল বিয়ে হয়েছে, বিমানদার মনমেজাজ বুঝে চলে, কিন্তু ছোড়দির তো বিয়ে পাঁচ মাসও হয়নি, এরই মধ্যে রঞ্জনদার কথায় ওঠে বসে, তোয়াজ করে চলে তাকে–আর সর্বদাই ভয়, এই বুঝি বকুনি খেতে হল।