…দুর্গাকে বিয়ে করতে পারার এই অবিশ্বাস্য কাণ্ডটা আর একটু বাদে ব্যক্ত করব। কারণ ওই একই ব্যাপার থেকে মধু রঙ্গনাথন-এর জীবনের দুটো দিক দেখা গেছে। …একটা জীবনের দিক, অন্যটা জীবন-মৃত্যুর দিক।
বম্বে গেলে ওদের অতিথি হতাম। দুর্গা আমাকে আদরযত্ন করত। এই দীর্ঘকালের মধ্যে ওরাও যুগলে এসে কলকাতায় অনেকবার আমার বাড়িতে থেকে গেছে। সেই শুরু থেকে দেখে এসেছি, মধু রঙ্গনাথনকে দুর্গা কড়া শাসনে রাখে।
বেশি বাঁচালতা করলে অন্য লোকের সামনেই ধমকে ওঠে। দুর্গা কলেজের মাস্টারি ছাড়েনি, স্বামীটির ওপর সর্বদাই ওর মাস্টারি মেজাজ। আমার কেমন ধারণা, দুর্গার ওই কড়া শাসন মধুর ভালো লাগে, আর সেই কারণে ওর গম্ভীর বাঁচালতা বাড়ছে। বই কমেনি।
কমিক অ্যাক্টর হিসেবে তার দস্তুরমতো নামডাক তখন। কিন্তু তার ছবির ভাঁড়ামোও দুর্গার চক্ষুশূল যেন। ও ব্যাপারের মাত্রা ছাড়ালে সে দস্তুরমতো রাগারাগি করে! একবারের ঘটনায় বম্বেতেই উপস্থিত ছিলাম আমি। মধুর একটা ছবি তখন। হৈ-চৈ করে চলছে। আমিও দেখে এলাম। ওর রোল আর অভিনয় দেখে পেটে খিল ধরার দাখিল। এক বড়লোকের বাড়ির ড্রাইভারের ভূমিকা ওর। নির্লিপ্ত বোকা-মুখ করে বড়লোকের বাড়ির কেচ্ছা দেখে অভ্যস্ত। ঘরে তার বিষম রাগী আর ঝগড়াটে স্ত্রী এবং একটি বয়স্থা মেয়ে। মেয়ে রূপসী নয় আদৌ। অতএব মেয়ের মা পছন্দ মতো পত্র পায় না। মাথা খাঁটিয়ে মেয়ের মা একটা রাস্তা বার করল। মেয়েকে বলল, বক্স নম্বর দিয়ে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দে–তাতে লেখা থাকবে বড়লোকের ছাব্বিশ বছরের একটিমাত্র মেয়ের জন্য শিক্ষিত সুশ্রী এবং দিলদরিয়া মেজাজের পুরুষ সঙ্গী চাই। মেয়ের বিবাহ কাম্য নয়, অন্তরঙ্গ মেলামেশাটুকুই কাম্য।
মেয়ের মায়ের আশা, এই টোপে বড়লোকের যোগ্য ছেলেরা ছুটে আসবে, আর অন্তরঙ্গ মেলামেশার পরেও মেয়ে মায়ের সাহায্যে একজনকে গেঁথে তুলতে পারবেই।
বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। কিছুদিন বাদে মা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার, বক্স নম্বরের বিজ্ঞাপনের জবাব আসছে না?
মেয়ে আমতা-আমতা করে জবাব দিল, একটা মাত্র এসেছে।
–কার কাছ থেকে? মা উদগ্রীব।
–সেটা একটু গোপনীয়, বলব না।
–হতচ্ছাড়ী মেয়ে, শীগগীর বল–কার কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিস?
কাতর মুখ করে মেয়ে জবাব দিল, বাবার কাছ থেকে।
এরপর ওই দজ্জাল মায়ের হাতে বাবার হেনস্থা দেখে হাসতে হাসতে দম বন্ধ হবার উপক্রম।
এই ছবি দেখে দুর্গা নাকি মধুর সঙ্গে কুরুক্ষেত্র করে ছেড়েছে। দুর্গা নিজেই আমাকে বলেছে, ছবিতে নিজের ওই প্রহসন মধু নাকি নিজেই বানিয়ে নিয়েছে। –আসল গলায় ওর কোনো ভূমিকা ছিল না।
কিন্তু যতই কড়া মেজাজ হোক, স্বামীর প্রতি দুর্গার প্রচ্ছন্ন যত্নটুকুও আমি স্বচক্ষে দেখেছি। ও কম খেলে বা শরীর একটু খারাপ হলে বকা-ঝকার ভিতর দিয়েও ওর আসল দরদের মূর্তিটা আমার চোখ এড়ায় নি।
…গত বছর অর্থাৎওদের বিয়ের প্রায় বিশ বছর বাদে হঠাৎ একদিন খবর পেলাম মধু দুর্গাকে খুইয়েছে। মাত্র তিনদিনের জ্বরে দুর্গা মারা গেছে।
শুনে মনটা কি যে খারাপ হয়েছিল নিজেই জানি। মধুকে দুতিনখানা চিঠি লিখেও জবাব পাইনি। মাস ছয় বাদে বম্বেতে খাবার আমার সুযোগ মিলল। এসেই ওর বাড়ি ছুটলাম। কিন্তু বাড়ি তালাবন্ধ, মধু নেই। কোথায় গেছে তাও কেউ বলতে পারল না। আজ চারমাস ধরে সে নাকি নি-পাত্তা। একসঙ্গে চার-পাঁচটি প্রযোজক ছবির মাঝখানে ওর জন্যে আটকে গিয়ে নাকি মাথায় হাত দিয়ে বসেছে।
আমার পরিচিত পরিচালক এবং আরো জনাকয়েকের মুখে ওর কথা শুনলাম। সকলেই বীতশ্রদ্ধ মধুর ওপর। কথায় কথায় পরিচালক বলল, ভাঁড়ের ভাড়ামীরও একটা সীমা আছে। বউ মরে যেতে সক্কলের সামনে শ্মশানে দাঁড়িয়ে পর্যন্ত মধু কি। করল জানেন? দুর্গাকে চিতায় শোয়ানো হয়েছে, আর মধু দুই চোখের জল ছেড়ে দিয়ে নিজের একটা হাতের উল্টোদিক মুখে ঠেকিয়ে চটচট শব্দ করে চুমু খেতে লাগল–যেন দুর্গাকেই ক্রমাগত চুমু খেয়ে চলেছে-তার চোখমুখের সে কি হাব-ভাব তখন। যারা ছিল তারা শোক করবে কি, হেসে সারা।
…হাতের উল্টোপিঠ মুখে ঠেকিয়ে শব্দ করে চুমু খাওয়ার একটা রহস্য আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তাই সকলে একটা ভঁড়ামী ভেবেছে।
…দুর্গাকে বিয়ে করতে পারার সেই অবিশ্বাস্য কাণ্ডটা এবারে ব্যক্ত করা যেতে পারে।
…মধুকে দুর্গা আমল দেবেই না। আর মধুও না-ছোড়। সেদিনের ঘটনা, সেই সকালেও নাকি দুর্গা দাবড়ানী দিয়ে মধুকে বাতিল করতে চেয়েছে, বলেছে, পুরুষকার থাকলে কোনো ছেলে ছবিতে ভাড়ামী করে না–সে একটি দুর্বল-চিত্ত অমানুষকে আবার বিয়ে!
সেই দুপুরেই একজন বান্ধবীর সঙ্গে দুর্গার দেড়শ-দুশ মাইল দূরে কোথায় যাবার কথা। মধুর হাতে কোনো কাজ নেই শুনে দুর্গার বাবা মধুকেই ওদের চলনদার ঠিক করে দিয়েছে। দুর্গার আপত্তি ছিল, কিন্তু এ-ব্যাপারে সোরগোল করে আপত্তি করতেও ওর রুচিতে বাধে। কিন্তু মধু সঙ্গে যাচ্ছে শুনে দুর্গার বান্ধবী মহাখুশি। সে আবার মধুর খুব ভক্ত।
ট্রেনের একটা খুপরিতে ওরা দুজন পাশাপাশি বসেছে, ওদের উল্টোদিকে মধু রঙ্গনাথন। দুর্গার বান্ধবী সেই থেকে ভারী খুশিমেজাজে মধুর সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করছে–আর অনর্গল তার প্রশংসা করে চলেছে। দুর্গা বেশির ভাগ সময়ই গম্ভার।