ট্রেনের দুদিনের সান্নিধ্যেই আমার মনে হয়েছিল, মধু রঙ্গনাথন একদিন বড় আর্টিস্ট হবে। কারণ দুদিনের মধ্যে দুবারও ওকে আমি হাসতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অথচ ওর কথা শুনে আমি এক-একবার অট্টহাস্য করে উঠেছি। কিন্তু অবাক কাণ্ড, ওর গাম্ভীর্যটা এতটুকু কৃত্রিম মনে হয়নি কখনো। যেন সত্যি ভাবলেশশূন্য পটের মূর্তি একখানা।
ওকে জিজ্ঞাসা করেছি, ছবিতে না হয় না-ই হাসলে, বাইরেও অত গাম্ভীর্য কেন?
মধু জবাব দিয়েছে। কোনটা হাসির ব্যাপার আর কোনটা নয় সেটা যাচাই করার ফাঁকেই হাসির সময়টা উৎরে যায়। তাছাড়া এক-এক সময় হাসি, যখন কেউ হাসে না তখন জোরে হেসে উঠি।
-কেন?
–তাতে অন্য লোকের আমাকে বোকা ভাবতে সুবিধে হয়। তারা হাসে।
ট্রেনের সেই দীর্ঘ দুদিনের অবকাশে অনেক মনের কথা আর মজার করা বলেছে। মধু রঙ্গনাথন। যত শুনেছি তত আমি ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি।
…বিয়ে করেছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে ও বলেছিল, এবারে কলকাতায় আসার আগেও বাবা তার একজন গেলাসের বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল। বাবা তার সঙ্গে থাকে না, অন্যত্র থাকে, আর সূয্যি ডুবলেই মদ নিয়ে বসে। নেশার ঘোরে সেদিন ওর ঘরে এসে গর্জন করে বলল, তোর বউ দরকার, একটা বউ এনে দিচ্ছি।
ছেলে সায় দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, তা তো দরকার…কিন্তু কার বউ আনবে? শুনে ওর বাবাও নাকি চিন্তায় পড়ে গেছে, বলেছে, তাই তো, কার বউয়ের দিকে আবার হাত বাড়াতে যাব!
…কলেজে পড়তে সমবয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্য নাকি পাগল হয়ে উঠেছিল মধু। শেষ পর্যন্ত সেই মেয়ের ওপর চড়াও হয়ে একদিন আবেদন জানাল, কি বললে তুমি বিশ্বাস করবে আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে বিয়ে করতে চাই?
মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে সেই মেয়ে নাকি জবাব দিয়েছে, মোটে তিনটে কথা বললে!
–কি কথা? কি তিনটে কথা? মধু আশান্বিত।
–এক লক্ষ টাকা।
মধু লম্বা লাফ মেরে পালিয়েছে।
…হয়তো বানানো গল্প সব। শুনে আমি হেসে অস্থির। কিন্তু ওর মুখে হাসি দেখিনি।
বর্তমানের মনের কথাও বলেছে। একটা মেয়েকে ভয়ানক ভালবাসে। ওখানকারই মেয়ে। তার বাপ য়ুনিভার্সিটির প্রোফেসার মেয়ের নাম দুর্গা। সে-ও য়ুনিভার্সিটিতে পড়ছে। ভালো ছাত্রী। কিন্তু মধুর থেকেও গম্ভীর নাকি। বিয়ের কথা একবার বলতে এমন তাকিয়েছিল যে মধুর জমে যাওয়ার দাখিল। অনেক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়া ওদের, সেই সুবাদে ছেলেবেলা থেকে জানাশুনা। মধুর সাফ সিদ্ধান্ত, দুর্গাকে হয়। বিয়ে করবে নয়তো খুন করবে। ওর মতে দুর্গা ভয়ানক অবুঝ মেয়ে, ওর জন্যই বেশি টাকা রোজগারের আশায় মধু ফিল্মে নেমেছে, মেয়ে কোথায় খুশি হবে তা না, উল্টে রাগে ফুটছে!
এ-গল্পও খুব যে বিশ্বাস করেছিলাম এমন নয়। কিন্তু বেড়াতে বেড়াতে একদিন ও আমাকে দুর্গার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাজির। তখনো ওর মতলব বুঝিনি। দুর্গাকে ডেকে বাংলা দেশের মস্ত লেখক বলে পরিচয় দিল আমার। আমার পরিচয় বড় করে তুলে নিজের কদর বাড়াতে চায় বোধহয়। কিন্তু বাংলা দেশের মস্ত লেখকের প্রতি দুর্গার তেমন আগ্রহ আছে মনে হল না। তবে মার্জিত রুচির মেয়ে, অভদ্রতাও করল না। সুন্দরী কিছু নয়, বেশ স্বাস্থ্যবতী সুশ্রী মেয়ে।
পরের চার-পাঁচ বছরের মধ্যে আরো বারতিনেক বম্বেতে এসেছি। মধুও আর একবার কলকাতায় আমার অতিথি হয়ে এসেছিল। কমিক অ্যাক্টর হিসেবে তখন মোটামুটি নাম হয়েছে ওর! আর আমার সঙ্গে বন্ধুত্বও গাঢ় হয়েছে। কিন্তু মধু রঙ্গনাথনের হাবভাব কথাবার্তা সেই একরকমই আছে। দুর্গার জন্য ওর হা-হুঁতাশ বেড়েছে। দুর্গা এখন কলেজের মাস্টার, ওর দিকে ভালো করে ফিরেও তাকাতে চায়
ফেরাবার চেষ্টা করলেও রেগে আগুন হয়। মধু রঙ্গনাথনের সুখশান্তি সব গেল। দুর্গাকে খুন করার সময় এগিয়ে আসছে কিনা এখন সেই চিন্তা করছে।
এর দুমাসের মধ্যে বম্বে থেকে মধুর উচ্ছ্বাসভরা চিঠি পেলাম, দুর্গাকে খুন করতে পেরেছে, অর্থাৎ বিয়ে করে ঘরে আনতে পেরেছে। সেই প্রহসন শুনলে বন্ধু (অর্থাৎ আমি) নিশ্চয় চমৎকৃত হবে। কিন্তু বিয়ে করার পর দুর্গারই উল্টে খুনী মেজাজ এখন। সকাল বিকেল দুপুর রাত্তিরে মুখ দিয়ে নয়তো চোখ দিয়ে ঝটাপেটা করে ছাড়ছে। কেবল মধুর একটু-আধটু শরীর-টরীর খারাপ হলে ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বড় ডাক্তার ডাকে, অতএব মধু প্রাণপণে শরীর খারাপ করতেই চেষ্টা করছে।
এরপর বম্বেতে এসে ওদের অতিথি হয়েছি। সত্যিই ভালো লেগেছে। মধু রঙ্গনাথন সেইরকমই গম্ভীর প্রায়; কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও যে আনন্দে ভাসছে তাও বোঝা যায়।
কি করে শেষ পর্যন্ত দুর্গাকে ঘরে আনা গেল, মধু একদিন চুপি চুপি তাও বলল আমাকে। শুনে আমি হাঁ। বিশ্বাস করব কি করব না ভেবে পেলাম না।
– বললাম, সত্যি বলছ কি বানিয়ে বলছ, দুর্গাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করব।
মধু আঁতকে উঠল।আমার পেশার দিব্বি কেটে বলছি, এক বর্ণও মিথ্যে বলিনি। –কিন্তু দুর্গাকে জিজ্ঞেস করতে গেলে ও ঠিক ডিভোর্স করবে আমাকে!
বিশ্বাস করেছি। কিন্তু যতবার মনে পড়েছে প্রহসনটা, নিজের মনেই হেসে বাঁচি না। মধুর মাথা বটে একখানা–এমন কাণ্ড করেও কাউকে বিয়ে করে ঘরে টেনে আনা যায়!