আবার ওই মুখে হাসি ভরাট হতে লাগল, গালে টোল পড়ল, ঠোঁট দিয়ে গাল দিয়ে নাক-চোখ-কান দিয়ে হাসি ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়তে লাগল যেন।
আত্মবিস্মৃতের মতো চেয়েই আছেন লোকনাথবাবু। তার মনে হতে লাগল, তেত্রিশ বছর আগে বাবুদীঘির নিরাপদ ব্যবধানে দাঁড়িয়ে বাঘের ডাক শুনেছে সকলে কদিন ধরে। বাঘিনীর নিঃশব্দ গর্জন কেউ শোনেনি।
মধুরঙ্গ
মধু রঙ্গনাথনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ছাব্বিশ-সাতাস বছর আগে। তার বয়স তখন পঁচিশ-ছাব্বিশ, আমারও তাই। ট্রেনে কলকাতা থেকে বম্বে যাচ্ছিলাম। আমার একটা গল্প ছবি করার ব্যাপারে সেখানে গরম তোড়জোড় চলছিল। বাংলা গল্পের হিন্দি ছবি হবে। হামেশাই হয়। কিন্তু সেই উঠতি বয়সে অমন ভাগ্য দুর্লভ মনে হয়েছিল। তাই মনে আনন্দ ছিল। ভিতরে বেশ একটু উত্তেজনাও ছিল। গল্পের কাঠামো একটু-আধটু অদল-বদল করার ব্যাপারে খোদ পরিচালকের টেলিগ্রাম পেয়ে ছুটেছি। পরের পয়সায় ফার্স্ট ক্লাসে তোফা আরামে যাচ্ছিলাম।
সেই সময় সামনের বার্থের একটি সমবয়সী অবাঙালী ছেলে আমার চোখ টেনেছিল। ছিপছিপে বেঁটে-খাট গড়ন, গায়ের রঙ কালোই বলা যায়। সে-ও আমার মতোই নিঃসঙ্গ যাত্রী, কিন্তু যতবার চোখাচোখি হয়েছে, দেখি অস্বাভাবিক গম্ভীর। অথচ ওই মুখের আদল কেমন যেন চেনা-চেনা ঠেকছিল আমার। ১৪৮
আলাপের চেষ্টায় এগিয়েছিলাম, কিন্তু লোকটা ভয়ানক নির্লিপ্ত আর নিরুত্তাপ। সে-ও বম্বে যাচ্ছে শুনে আমি একটু উৎসাহ বোধ করেছিলাম, কিন্তু তার ঠাণ্ডা হাবভাব দেখে সেটা বেশিক্ষণ থাকল না। ভাবলাম আমি পরের পয়সায় কায়দা করে ফার্স্ট ক্লাসে চলেছি, এ হয়তো পয়সাঅলা কোন বড়লোকের ছেলে হবে, সেই দেমাকে এত গম্ভীর। অতএব আমিও বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত নিস্পৃহ থাকতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু যতবার তার দিকে চোখ গেছে ততবার মনে হয়েছে এই মুখ আমি কোথাও দেখেছি।
একবার ও নিজের ছোট সুটকেসটা টেনে এনে খোলার মুখে ডালার ওপর লেবেল আঁটা নাম চোখে পড়ল–মধুরঙ্গ। এই নাম দেখে কোন দেশের বা কোন জাতের মানুষ ঠাওর করা গেল না। কিন্তু সুটকেস থেকে যে বস্তুটা বার করল, দেখে আমার চক্ষুস্থির। লম্বাটে ধরনের এক বাণ্ডিল বিড়ি। কোন ফার্স্ট ক্লাসের প্যাসেঞ্জারের মুখে বিড়ি দেখব এটা তখন কল্পনার বাইরে। একটা বিড়ি নিজের ঠোঁটে ঝোলাল। আমাকে চেয়ে থাকতে দেখে ড্যাবড্যাব করে সেও খানিক চেয়ে রইল। তারপর ইংরেজিতে মন্তব্য করল–ফাইন স্টাফ, চলবে?
আমি হকচকিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালাম। অতি সাধারণ একটা লাইটার জ্বালিয়ে সে আমার বিড়ি ধরিয়ে দিয়ে নিজেরটা ধরাল। তারপর মস্ত একটা তৃপ্তির টান।
আমাদের কাণ্ড দেখে কামরার অপর দুই প্রায়-বৃদ্ধ দম্পতি অন্যদিকে মুখ ফেরাল।
সাধারণ বিড়ি, আকারে একটু বড়, এমন কিছু ফাইন স্টাফ বলে আমার মনে হল না। কিন্তু ঐ লোকটা খুব মৌজ করে টানছে। আধাআধি শেষ করে আমার দিকে ফিরল আবার। তেমনি নির্লিপ্ত মন্তব্য করল, খুব সস্তা বলে এ জিনিসটা আরো ভালো। লাগে, একগাদা কিনে নিয়েছি।
ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রীর মুখে এ-কথা শুনে একটু যেন ধাক্কাই খেলাম। বলে ফেললাম, শুধু সস্তা বলে বিড়ি খান, না কড়া জিনিসের লোভে?
জবাব দিল, চুরুট আরো কড়া, আরো বেশি ভালও লাগে, কিন্তু বেশি দাম–
হেসেই জিজ্ঞাসা করলাম, এত দূরের পথ ফার্স্ট ক্লাসে যাচ্ছেন অথচ বেশি দামের জন্য চুরুট কিনে খান না?
বিড়িতে শেষ টান দিয়ে সাদাসাপটা জবাব দিল, আমিও আপনার মতই ফোকটে ফার্স্ট ক্লাসে যাচ্ছি–নিজের পয়সায় থার্ড ক্লাসে যেতে হলে চোখে সর্ষেফুল দেখতে হয়!
আমি হতভম্ব। ও ফোকটে মানে পরের পয়সায় যাচ্ছে সেটা নিজে বলল, কিন্তু আমি কার ঘাড়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছি সে তো আমার গায়ে লেখা নেই–জানল কি করে!
আমার বিস্ময় ওর নিস্পৃহ বিশ্লেষণের বস্তু যেন। নিজে থেকেই বলল, আপনি তো অমুক প্রযোজকের অমকু ছবির স্ক্রীপট-এর কাজে সাহায্য করতে যাচ্ছেন?
বিমূঢ় মুখে মাথা নাড়লাম।
কড়ে আঙ্গুলের ডগটা নিজের কানের গহ্বরে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘন-ঘন নাড়ল একপ্রস্থ। আয়েসে চোখ দুটো ছোট হয়ে এলো। তারপর রয়েসয়ে বলল, আমি বাংলা কথা-বার্তা মোটামুটি বুঝি, আপনাকে যারা তুলে দিতে এসেছিল তাদের আর আপনার কথা থেকেই জেনেছি কেন বম্বে যাচ্ছেন–আপনার ওই ছবিতে আমিও একটা রোল পাবার চেষ্টা করেছিলাম–হল না।
আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি ফিলম আর্টিস্ট?
মাথা নাড়ল।-আর্টিস্ট ঠিক না, ফিলম-ভাঁড় বলতে পারেন।
সুটকেসের লেবেলে নাম দেখেছি মধুরঙ্গ। এই নামের কোন কমিক অ্যাকটর স্মরণে আসছে না। অথচ মুখখানা চেনা-চেনা লাগছে। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি শেষ কোন ছবিতে কাজ করেছেন?
বলল– আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল আমার। হ্যাঁ, হাঁড়ি-মুখো এক কিশোর জবর হাসিয়েছিল বটে এই ছবিটাতে। আর্টিস্ট-এর নামটাও মনে পড়ে গেল তখুনি।
শুধোলাম, আপনার নাম কি?
–মধু রঙ্গনাথন। ছেঁটে সেটাকে মধুরঙ্গ করেছি। ফিল্মের নাম ভিন্ন।
সেই ভিন্ন নাম আজ সুপরিচিত। আর সেই কারণেই নামটা অনুক্ত থাক।
ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগে সেই দুদিনের যাত্রাপথে মধু রঙ্গনাথন আমার অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিল। সেই বন্ধুত্ব দিনে দিনে বেড়েছে। বম্বেতে সেই প্রথমবারে পৌঁছেও বড়লোকের আতিথ্য ছেড়ে ওর একখানা ঘরেরই ভাগীদার হয়েছিলাম। আর আমার সক্রিয় চেষ্টার ফলে পরিচিত ডিরেক্টার ভদ্রলোক প্রযোজককে বলে ওর একটা রোলের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন।